আইন, ও বিচারএক্সক্লুসিভরাজনীতিরাষ্ট্রনীতি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান: শোষণের রাষ্ট্র থেকে মুক্তির সংগ্রাম

ডেস্ক রিপোর্টঃ স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশ এমন এক ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছে, যেখানে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। এই রাষ্ট্রে ক্ষমতা মানে হলো দখল, শাসন মানে হলো দমন। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ বিশেষ করে ছাত্র সমাজ, শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে বুঝে ফেলেছে, এই রাষ্ট্রব্যবস্থা তাদের নয়। এর ভেতর থেকে তাই উঠে এসেছে নতুন চেতনা, নতুন প্রত্যয়: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। এই নথি সেই ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ যেখানে রাষ্ট্রশাসনের ব্যর্থতা, প্রতারিত স্বাধীনতা এবং নতুন বিপ্লবের সম্ভাবনা একসাথে ধরা পড়ে।

অধ্যায় ১: রাষ্ট্রের নির্মাণ ও বিশ্বাসঘাতকতা:

বাংলাদেশের রাষ্ট্র নির্মাণ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানের দমনমূলক ও উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি শোষণমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্নকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ।

১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল এই স্বপ্নের লিখিত রূপ। এতে চারটি মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে ছিল মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং সর্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণের প্রতিশ্রুতি।

কিন্তু এই আদর্শিক সংবিধান খুব অল্প সময়েই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় দখলে নিতে শুরু করে। এর চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন এর মধ্য দিয়ে, যখন বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করা হয়।

এর ফলে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, বাকস্বাধীনতা স্তব্ধ হয়ে যায়, এবং গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের দমনমূলক কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম হয়। এরপর পরপর তিনটি সামরিক অভ্যুত্থান (১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর ১৯৭৫) দেশকে নিয়ে যায় সামরিক দুঃশাসনের দিকে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের শুরুতেই তার মৌলিক চেতনাকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও ক্ষমতার লোভের কারণে। এই বিশ্বাসঘাতকতার ধারাবাহিকতা পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রয়ে গেছে।

সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে অসাংবিধানিক শোষন: ১৯৭১ বনাম ১৯৭২ – মূলনীতির পরিবর্তন ও জটিলতার শুরু

১. মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধান ও মূলনীতি (মুজিবনগর, ১৯৭১):

১৯৭১ সালে গঠিত মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী সংবিধান (Proclamation of Independence) ছিল মূলত স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার একটি ঘোষণাপত্র, যার তিনটি মৌল নৈতিক ভিত্তি ছিল:

  • সাম্য (Equality)
  • মানবিক মর্যাদা (Human Dignity)
  • সামাজিক ন্যায়বিচার (Social Justice)

এই তিনটি ধারণা ছিল অধিকতর সার্বজনীন, মানবিক এবং উপনিবেশ বিরোধী রাজনীতির একটি র‍্যাডিক্যাল প্রকাশ। এতে জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, ভাষা কোনো কিছুর ভিত্তিতেই বিভাজন অনুমোদন ছিল না।

২. ১৯৭২ সালের সংবিধানে নতুন মূলনীতি:

১৯৭২ সালে গণপরিষদের মাধ্যমে প্রণীত সংবিধানে নতুন চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সংযোজিত হয়:

  • জাতীয়তাবাদ (Bengali Nationalism)
  • গণতন্ত্র (Democracy)
  • সমাজতন্ত্র (Socialism)
  • ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)

এই চারটি মূলনীতির উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংবিধানিক রূপায়ণ। কিন্তু এই পরিবর্তন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে কিছু গভীর জটিলতা তৈরি করে:

৩. উদ্ভূত জটিলতা:

ক. জাতীয়তাবাদের সংকট:
  • “বাঙালি জাতীয়তাবাদ”কে একমাত্র রাষ্ট্রীয় পরিচয় হিসেবে ঘোষণায় আদিবাসী ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে সাংবিধানিকভাবে অস্বীকৃতি দেওয়া হয়।
  • পাহাড়ি, মারমা, চাকমা, সাঁওতাল, ও রাজবংশীদের আত্মপরিচয় সংকটে ফেলা হয় এবং একধরনের “ঐক্যবদ্ধ জাতি”র নামে জাতিগত বৈচিত্র্য দমন শুরু হয়।
খ. সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক বিভ্রান্তি:
  • সংবিধানে “শোষণহীন সমাজব্যবস্থা”র প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, ১৯৭২-৭৫ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ও লুটের রাজনীতি সংহত হয়।
  • জাতীয়করণের নামে আমলাতন্ত্র ও দলীয়করণ তৈরি হয়, যা একদলীয় শাসন ও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ববাদে পরিণত হয়।
  • ফলে সমাজতন্ত্রের নামে স্বাধীনতার মূল চেতনার বিরুদ্ধে উল্টো ধারা তৈরি হয়।
গ. ধর্মনিরপেক্ষতার অস্পষ্টতা ও দ্বৈতনীতি:
  • একদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম বা হিন্দুধর্মীয় উপাদানকে কখনো কখনো ব্যবহার করা হয়।
  • ১৯৭৫-৮৮ পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনের সময় ধর্মনিরপেক্ষতার অপমৃত্যু ঘটে, এবং সংবিধানের মূলনীতিগুলো দুর্বল ও বিতর্কিত হয়ে পড়ে।
ঘ. গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কিন্তু রাজনৈতিক অপচর্চা:
  • ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্র থাকলেও, দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, দলীয়করণ ও জরুরি ক্ষমতার অপপ্রয়োগ গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
  • ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা হয়, যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৪. রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ও ২০২০-এর বাস্তবতা:
  • এই চার মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এখন প্রায় নির্বাসিত; জাতীয়তাবাদ বিভাজন তৈরি করেছে; গণতন্ত্র রূপ নিয়েছে প্রতীকী আনুষ্ঠানিকতায়।
  • ফলে ২০২৩-২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এক অর্থে ১৯৭১ সালের মূল চেতনায় ফিরে যাওয়ারই আর্তনাদ: সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের রাষ্ট্র চাই।

১৯৭১-এর যুদ্ধের নৈতিক ভিত্তি ছিল বৈষম্যহীনতা ও মুক্তি। কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধান সেই চেতনার একরকম “রাজনৈতিক পুনর্নির্মাণ” করে, যা কিছু সময় পরেই স্বৈরতন্ত্র, জাতীয়তাবাদী দমননীতি ও লুটপাটের কাঠামো তৈরি করে দেয়। এই অসামঞ্জস্যই পরবর্তী ৫০ বছরে একটি গভীর রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয় যা আজকের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত হচ্ছে।

অধ্যায় ২: ক্ষমতা দখলের ক্রমধারা (১৯৭৫–১৯৯১)

১৯৭৫ – হত্যাকাণ্ড ও সামরিক অভ্যুত্থানের শুরু: ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে সপরিবারে হত্যা করা হয় একদল বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তার হাতে। এই হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং সামরিক আইন জারি করেন।

৩ নভেম্বর ১৯৭৫ – জেলহত্যা ও অভ্যুত্থান: ৩ নভেম্বর আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এর ঠিক পরেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা (তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী)কে হত্যা করা হয়।

৭ নভেম্বর ১৯৭৫ – পাল্টা অভ্যুত্থান ও জিয়াউর রহমানের উত্থান: ৭ নভেম্বর এক ব্যতিক্রমী সৈনিক-জনতা বিপ্লবে খালেদ মোশাররফ নিহত হন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন। তিনি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৮১ – জিয়ার মৃত্যু: ৩০ মে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সাময়িকভাবে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন।

১৯৮২ – এরশাদের সামরিক শাসন: ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে সেনাবাহিনীর প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি এফ.এম. আহসানউদ্দিন চৌধুরী। পরে এরশাদ নিজেই রাষ্ট্রপতি হন এবং সামরিক শাসন জারি রাখেন।

১৯৯০ – গণআন্দোলনে এরশাদের পতন: বিরোধী দল ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে এরশাদ পদত্যাগ করেন। এতে অবসান ঘটে টানা নয় বছরের সামরিক শাসনের।

১৯৯১ – গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন: এরশাদের পতনের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায় এবং খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

একের পর এক সামরিক শাসন, হত্যাকাণ্ড, এবং রাজনৈতিক চক্রান্ত রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে ভেঙে দিয়েছে। এর ফলে ছাত্র ও জনসাধারণের মাঝে এক অভ্যুত্থানের ধারাবাহিক প্রস্তুতির সূচনা হয়।

অধ্যায় ৩: গণতন্ত্রের নামে দলীয় শাসন ও কর্তৃত্ববাদের উত্থান (১৯৯১–২০২৩)

১৯৯১ – গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ও খালেদা জিয়ার সরকার: সাংবিধানিক দ্বাদশ সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসে এবং খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এই সরকার আমলেও নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই আইন পাস এবং আওয়ামী লীগকে দমন করার প্রবণতা প্রকট হয়।

১৯৯৬ – আওয়ামী লীগের পুনঃউত্থান: বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। তার সরকারের সময় গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন, তবে বিরোধীরা এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই দেখেছে।

২০০১ – আবার বিএনপি ও জোট রাজনীতির প্রতিক্রিয়া: ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট পুনরায় ক্ষমতায় আসে। এই সময়ে দেশব্যাপী জঙ্গি হামলা, রাজনৈতিক হত্যা এবং বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে। সরকারের প্রশাসনিক দলীয়করণ এবং বিরোধীদের প্রতি সহিংস মনোভাব গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে।

২০০৭ – সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার: ২০০৬ সালের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দ্বন্দ্বের ফলে রাজনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছায়। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীকে কারাবন্দি করা হয় এবং দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানো হয়, যদিও এসব কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল।

২০০৮ – শেখ হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন: ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে। এর পর থেকে শুরু হয় একটানা শাসনামল। তবে এই সময়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, যা বিরোধী দলগুলোর মধ্যে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

২০১৪ ও ২০১৮ – বিতর্কিত নির্বাচন ও কর্তৃত্ববাদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ: ২০১৪ সালে বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে। ফলে একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন নির্বাচন কমিশন, সংসদ, ও গণমাধ্যম কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

২০২৩ – দমননীতি ও জনগণের স্নায়ুযুদ্ধ: ২০২৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি কার্যত কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, পুলিশি নির্যাতন, বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব সাধারণ জনগণের ক্ষোভকে তীব্র করে তোলে। ছাত্রসমাজ, নতুন প্রজন্মের তরুণরা আবারও রাস্তায় নামতে শুরু করে। ‘গণতন্ত্র’, ‘উন্নয়ন’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এসব শব্দ হয়ে ওঠে শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার, আর জনগণের জন্য নিছক প্রতারণা।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে কেবলমাত্র একটি খোলস ছিল, যার ভেতরে লুকিয়ে ছিল দলীয় স্বৈরতন্ত্র। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্র-জনতার নতুন জাগরণ এক অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে ওঠে।

অধ্যায় ৪: অভ্যুত্থানের কারণসমূহ

১. রাষ্ট্রের চরম দলীয়করণ: প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান শাসক দলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় সাধারণ নাগরিকদের আস্থা চরমভাবে হারিয়ে যায়।

২. নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস: ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাত জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি হতাশা তৈরি করে।

৩. বাকস্বাধীনতার দমন: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অপপ্রয়োগে সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, মানবাধিকারকর্মীসহ সকল ভিন্নমতকে দমন করা হয়।

৪. অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দুর্নীতি: সীমাহীন লুটপাট, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার ধস ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন সাধারণ মানুষের জীবনধারায় গভীর সংকট সৃষ্টি করে।

৫. তরুণদের ভবিষ্যৎহীনতা: বেকারত্ব, শিক্ষার গুণগত অবনতি, বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা এবং ন্যায্য কর্মসংস্থানের অভাব তরুণদের হতাশ করে।

অধ্যায় ৫: অভ্যুত্থানের চরিত্র

এই অভ্যুত্থান ছিল:

  • অরাজনৈতিক নয়, কিন্তু অদলীয়: মূল নেতৃত্ব ছাত্র ও তরুণদের হাতে, যারা বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে।
  • নেতাবিহীন নয়, নেতৃত্বহীন নয়: সমষ্টিগত নেতৃত্ব, বিকেন্দ্রীভূত কর্মসূচি ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালিত হয়।
  • প্রযুক্তিনির্ভর ও স্বতঃস্ফূর্ত: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিকেন্দ্রীকৃত যোগাযোগের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তার ঘটে।
  • মূলত অহিংস কিন্তু দুর্দমনীয়: সহিংসতা আন্দোলনের চরিত্র নয়, তবে আত্মরক্ষার অধিকারকে পরিত্যাগ করেনি।
  • রাজনৈতিকভাবে র‍্যাডিক্যাল, কিন্তু নৈতিকভাবে গণতান্ত্রিক: ক্ষমতার লোভ নয়, বরং জনগণের অধিকার পুর্ন দাবিই ছিল আন্দোলনের চালিকা শক্তি।

অধ্যায় ৬: অভ্যুত্থানের দাবিপত্র

আন্দোলন চলাকালীন যখন দমন–পীড়ন বাড়তে থাকে, তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি ৯ দফা দাবিপত্র প্রকাশ পায়। এই ৯ দফা পরে সার্বিক আন্দোলনের অভিন্ন চেতনায় সংহত হয়ে রূপ নেয় একমাত্র ঐক্যবদ্ধ মূল দাবিতে:

১ দফা: ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।

এই এক দফার মধ্যেই সন্নিবেশিত হয় অন্যান্য সকল দাবির সারাংশ, যার মধ্যে রয়েছে:

১. নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার পুনর্বহাল।

২. সংবিধান সংস্কার ও গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো পুনর্নির্মাণ।

৩. সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি ও দমনমূলক আইন বাতিল।

৪. নতুন রাজনৈতিক শক্তি গঠনের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা।

৫. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও বাসস্থানের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন।

৬. জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা।

৭. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও পুলিশি জবাবদিহিতা।

৮. ব্যাংক লুটপাট, নির্বাচন কারচুপি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার।

অধ্যায় ৭: নেতৃত্ব ও সংগঠনের কাঠামো

আন্দোলনের নাম ও প্রতিষ্ঠা

“বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” (বাংলায় সংক্ষেপে বৈছাআ, ইংরেজিতে Students Against Discrimination) গঠিত হয় ১ জুলাই ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ৮ জুলাই ৬৫ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়, যা ৩ আগস্টে বাড়িয়ে ১৫৮ সদস্যের উদ্যোক্তা হিসেবে গঠন লাভ করে৷

আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম

  • প্রাথমিকভাবে কোটা সংস্কার ও সরকারি চাকরি থেকে বৈষম্য দূরীকরণে সংগঠিত, শিগগিরই এটি অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয় ।
  • “বাংলা ব্লকেড” কর্মসূচি ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক বন্ধ করে আন্দোলনের বিস্তার ঘটানো হয়।

নেতৃস্থানীয় সদস্য ও ভূমিকা

সংগঠনের ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক ৮ জুলাই ঘোষিত কমিটির মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন:

  • নাহিদ ইসলাম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজবিজ্ঞান)
  • রিফাত রশিদ, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, আরিফ সোহেল ইত্যাদি।
    ৩ আগস্ট বোঝা যায় ১৫৮ সদস্যের কমিটিতে ৪৯ জন সমন্বয়ক ও ১০৯ জন সহ-সমন্বয়ক রয়েছেন।

সংঘাত ও ভেঙে পড়া

  • ১৯ জুলাই অন্তঃকমিটিতে মতবিরোধ ও নেতাদের গ্রেপ্তার-হেফাজতের পর ২১ জুলাই ‘৯ দফা’ দাবি নিয়ে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করা হয়।

মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

  • আন্দোলনের বিভিন্ন সময় জখম ও গ্রেপ্তার কন্টেন্ট দেশি বিদেশি গনমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ।

সংগঠনের কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য

  • উদ্যোগমূলক স্তর: সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়ক দ্বারা পরিচালিত, জাতীয় স্তরে বিকেন্দ্রীকৃত কর্মসূচি।

অধ্যায় ৮: অভ্যুত্থান পরবর্তী জটিলতাঃ

১. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও তাদের গঠন পরিবর্তনের প্রয়োজন
বর্তমান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে কাজ করে, সেটাতে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে দুর্নীতি, অকার্যকরতা, স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা ইত্যাদি। তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ করার পদ্ধতি এবং গঠনে মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার।

২. নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত (চুক্তি)
একজন নাগরিক এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তি বা ‘বন্দোবস্ত’ থাকে, যেখানে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারিত হয়। এই নতুন বাস্তবতায়, জনগণ নতুন ধরনের একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চায় যেখানে তাদের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত থাকবে।

৩. নতুন সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা
এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার জন্য একটা নতুন সংবিধান আবশ্যক, কারণ বর্তমান সংবিধান হয়তো পুরোনো বাস্তবতা এবং ভাবনায় গড়া।
নতুন সংবিধানে অবশ্যই থাকবে:

  • মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের প্রতিফলন, যা আমাদের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি।
  • ২০২৪-এর নতুন প্রজন্মের বাস্তবতা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যারা আধুনিক, তথ্যভিত্তিক, মানবাধিকারে বিশ্বাসী এবং স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই।

এই অভ্যুত্থান কোনো সাময়িক উন্মাদনা নয়; বরং দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্রপুনর্গঠনের একটি সংগ্রাম। এর সফলতা নির্ভর করবে সংগঠনের গভীরতা, জনগণের ঐক্য এবং নেতৃত্বের বিচক্ষণতার ওপর।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button