জনস্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউট লুটেরহাট নাটের গুরুদের কথা

0
1422

এ এস মুনীর ঃ
জনস্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউট অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থেকে শুরু করে ইউনিট তত্ত্বাবধায়ক ও উৎপাদন ব্যবস্থাপক, ক্রয় কর্মকর্তা, হিসাব বিভাগের উচ্চমান সহকারী ও হিসাব সহকারীসহ একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজচক্র বহুদিন ধরে জনস্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউটকে অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়ে রেখেছেন। শক্তিশালী এদুর্নীতিবাজচক্রটি অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতি অর্থবছর কেনাকাটার নামে ভূয়া বিল ভাউচার তৈরি করে অবাধে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জনস্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউট লুটেরহাটের নাটেরগুরা হলেন, সাবেক পরিচালক ডা. এ কে এম জাফর উল্যাহ, বর্তমান পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাসের চাকরির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে চলতি বছরের ১ জুন। সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ, উর্ধ্বতন ক্রয় কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান চৌধুরী, হিসাব শাখার উচ্চমান সহকারী মোঃ হারুন ও একই শাখার হিসাব সহকারী মাহবুবুর রহমান আরিফ।
সূত্রে প্রকাশ দুর্নীতির দায়ে ইতোপূর্বে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ ৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ লিখিত অভিযোগ করা হয়। দীর্ঘদিন পার হলেও অভিযোগটি এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। দুর্নীতির কুশিলবরা টাকার জোরে খোদ দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেস্কের যুগ্ম-সচিবের মতো বড় আমলাকে ম্যানেজ করে আইপিএইচে বহাল থেকে অবাধ লুটপাট অব্যাহত রেখেছেন তারা।
অভিযোগে প্রকাশ উক্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরস্পর যোগসাজশে ২০১৪-১৫ অর্থবছর ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আই.ভি.এফ শাখার স্যালাইন ব্যাগ তৈরি ও স্যালাইন ব্যাগ জোড়া লাগানোর জন্য ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ২টি মেশিন ক্রয় করা হয়। দুর্নীতিবাজচক্রটি ৩০% কমিশন গ্রহণ করে কার্যাদেশ মোতাবেক জাপানী মেশিনের স্থলে নিম্ন মাণের চায়না মেশিন গ্রহণ করে। ফলে উক্ত মেশিন ২টি চালু করার ৬ মাসের মাথায় অকেজ হয়ে যায়।
অভিযোগে রয়েছে যে, একইভাবে ব্লাড ব্যাগ উৎপাদন ইউনিটের জন্য ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিলাশী বাজেটে একটি নিম্ন মাণের মেশিন ক্রয় করা হয়। উক্ত মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উচ্চমাত্রার কমিশন গ্রহণ করেন দুর্নীতিবাজ চক্রটি।
সূত্র জানায়, আইপিএইচ অরগানোগ্রামে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কোনো পদ না থাকা সত্তেও শুধু কমিশন প্রাপ্তির লক্ষ্যে আইপিএইচ ল্যাবের জন্য উচ্চমূল্যে একটি নিম্ন মাণের আল্টাসোনোগ্রাফী মেশিন ক্রয় করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার ফলে ক্রয়কৃত উক্ত মেশিনটি এখন পর্যন্ত অলোস পরে আছে। জনশ্রুতি আছে উক্ত মেশিনটি ক্রয়ে  মোটা অঙ্কের সরকারি টাকা গচ্ছা গেলেও লাভবান হয়েছে উক্ত দুর্নীতিবাজচক্রটি।
এছাড়া আইপিএইচের ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানের এক খাতের বরাদ্দের টাকা অন্য খাতে খরচ দেখিয়ে মালামাল ক্রয় না করে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে প্রায় ৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। জনস্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউটের নাম সংক্ষেপে পিতলের তিন অক্ষর দ্বারা আইপিএইচ লিখে সরকারের ২ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে তারা চেয়ারম্যান বাড়ীর এমিকোন নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছেন। আরো অভিযোগ রয়েছে যে, ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো ধরনের মালামাল ক্রয় না করে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে লুটেরাচক্রটি প্রতিষ্ঠানের ৮৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইপিএইচের অপর একটি সূত্র জানায়, আইপিএইচের আই.ভি.এফ শাখার মেশিন মেরামতের নামে প্রায় ২০ কোটি টাকা এবং ব্লাড ব্যাগ শাখার মেশিনপত্র মেরামতের নামে প্রায় আরো ৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দুর্নীতিবাজ চক্রটি। সূত্র আরো জানায়, আইপিএইচের জন্য ৫০ কোটি টাকায় অপ্রয়োজনীয় একটি গ্যাস চালিত জেনারেটর ক্রয় করা হয়। জনশ্রুতি আছে দুর্নীতিবাজচক্রটি জেনারেটর সরবরাহকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪০% কমিশন আদায় করেছে। উক্ত জেনারেটরটি ক্রয়ের পর আজ পর্যন্ত সংযোগ বিহীন অবস্থায় পরে আছে। অভিযোগ সম্পর্কে অভিযুক্তদের বক্তব্য জানার জন্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাসের মুখোমুখি হলে প্রথমে তিনি কৌশল অবলম্বন করে প্রতিবেদককে সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদের সাথে দেখা করতে বলেন। সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদের সাথে দেখা করে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আদেশের গোলাম। পরিচালক এবং উপ-পরিচালক আমাকে যে আদেশ প্রদান করেন আমি তা পালন করি মাত্র। আমার আলাদা কোনো ক্ষমতা নেই। আমি ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানের আয়ন ব্যয়ন কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছি। বর্তমান পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাস উপ-পরিচালক থাকাকালীন ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত আয়ন ব্যয়ন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছে। প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত নেই সে দাবি করেন। পিতল দ্বারা তিন অক্ষরে আই. পি. আইচ লিখে সরকারের ২ লাখ ২০ হাজার টাকা লোপাট সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আজাদ বলেন, আমি শুধু ফাইলে স্বাক্ষর করেছি। যা করার আয়ন ব্যয়ন কর্মকর্তা ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাস ও সাবেক পরিচালক ডা. এ কে এম জাফর উল্যাহ এবং প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন ক্রয় কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান করেছে। এ সম্পর্কে তারাই ভালো বলতে পারবে। এছাড়া উত্থাপিত অন্য কোনো অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িত নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানে প্রতিবেদকের কাছে দুর্নীতির স্পষ্টচিত্র ধরা পড়ে। তথ্যানুসন্ধানে মহাদুর্নীতিবাজ হিসেবে সামনে চলে আসেন সাধুবেশে বসে থাকা বর্তমান পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাসেন নাম। পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাসের মুখোমুখি হলে তিনি প্রতিবেদকের সাথে এলোমেলো কথা বলতে শুরু করেন। এক পর্যায় তার রুমে ডাকেন, তার খাস লোক বলে খ্যাত দুর্নীতির নাটের গুরুদের প্রধান উর্ধ্বতন ক্রয় কর্মকর্তা (এসপিও) মনিরুজ্জান চৌধুরী ও সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদকে।
পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাস,  সহকারী পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ ও উর্ধ্বতন ক্রয় কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান চৌধুরী মুখোমুখি হলে থলের কালো বিড়াল বেড়িয়ে আসতে শুরু করে। প্রথমে সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, বাংলাদেশের সেরা ক্রয় কমিটি আইপিএইচে’র। এখানে দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতির অন্যান্য অভিযোগের সাথে মালামাল ক্রয় না করে ভূয়া বিল ভাউচারে ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ৮৭ লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ সম্পর্কে পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। একবার সাবেক পরিচালক ডা. এ কে এম জাফর উল্যার কথা বলে তিনি পাড় পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এক পর্যায় তার মুখ খোলেন ক্রয় কর্মকর্তা মনিরুজ্জান চৌধুরী, তিনি প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক ডা. এ কে এম জাফর উল্যাহ ও বর্তমান পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাসকে ইঙ্গিত করে বলেন, তারা প্রতিষ্ঠানের ক্রয় কর্মকর্তাকে অন্ধকারে রেখে ১ থেকে ১৩ অক্টোবর’২০১৬ তারিখ পর্যন্ত কোনো মালামাল ক্রয় না করে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে আয়ন ব্যয়ন কর্মকর্তা তৎকালীন উপ-পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাসের মাধ্যমে ৮৭ লাখ টাকা উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ করে এবং ভূয়া বিল ভাউচার তৈরির কাজে হিসাব শাখার সহকারী মাহবুবুর রহমান আরিফকে নিয়োজিত করা হয়। উক্ত সরকারি টাকা আত্মসাতের সাথে জড়িত নেই বলে মনিরুজ্জামান দাবি করেন।
অভিযোগ সম্পর্কে জানার জন্য সাবেক পরিচালক ডা. এ কে এম জাফর উল্যার মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয় প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন আয়ন ব্যয়ন কর্মকর্তা বর্তমান পরিচালক ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র দাস এবং ক্রয় কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান ভালো বলতে পারবেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

eleven − five =