ভেজালের মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তি হোক

1
1041

নকল ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। গত এক বছরে নিম্নমানের ওষুধ উতপাদন ও বিক্রয়ের অভিযোগে করা মামলার দিকে তাকালেই বিষয়টি অনুমেয়। এ সময়ে দুই হাজারেরও বেশি মামলা করা হয়েছে। তারপরও ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ উতপাদন বা বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না। এদিকে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উতপাদন ও

 

বিক্রি স্বাস্থ্য খাতে ক্রমাগত উদ্বেগ বাড়িয়ে চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৃশ্যমান উদ্যোগের পাশাপাশি ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উতপাদনকারীদের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে। এজন্য সামাজিক সচেতনতা জরুরি। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সারা দেশে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উতপাদন ও বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত মামলা দায়ের করেছেন ২ হাজার ১৬৯ টি এর বাইরেও একই অভিযোগে ড্রাগ আদালতে মামলা হয়েছে ৪১টি ও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ৬৪টি। মামলার পাশাপাশি ৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকারও বেশি জরিমানা করা হয়েছে। ১৭ কোটি টাকার ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ জব্দ ও ধ্বংস করা হয়েছে। সিলগালা করা হয়েছে ৩৭টি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ৫৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সিনিয়র ড্রাগ সুপার পত্রিকাটিকে বলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জনবল বেড়েছে। সেই সঙ্গে তদারকি ও দেশব্যাপী নকল–ভেজাল বিরোধী অভিযানও জোরদার করা হয়েছে। ফলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা ও মামলার সংখ্যা বেড়েছে। নিম্নমানের ওষুধ উতপাদনকারীদের বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসনের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

 

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপকতা যে বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা শহর–বন্দর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত। বেসরকারি হাসপাতাল–ক্লিনিক–প্যাথলজি সুবিধারও বিস্তৃতি ঘটেছে। জীবনরক্ষাকারীসহ প্রয়োজনীয় প্রায় সব ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে। কয়েকটি কোম্পানির পণ্য উন্নত বিশ্বের বাজারেও জায়গা করে নিতে পেরেছে। তবে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সমস্যাও কম নেই। এক্ষেত্রে অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে নকল ও ভেজাল ওষুধ বাজারজাত করার বিষয়টি। দেশে কোনভাবে নকল ওষুধের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। এমন নয় যে, এটা প্রতিকারে কোনো আইন নেই। ভেজাল ও নকল ওষুধ উতপাদন এবং এ ওষুধ সেবনে কারো মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ আইনে ১০ বছর কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু ওষুধ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মামলাগুলো দুর্বল করে ফেলা হয়। ফলে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় ভুক্তভোগীরা। এমন কি নিম্নমানের কিংবা ভেজাল ওষুধ সেবনে মৃত্যু হলেও সবক্ষেত্রে দণ্ড নিশ্চিত হয় না। এটা খুবই বেদনাদায়ক।

 

ইদানীং অবশ্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আগের চেয়ে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। অধিদপ্তরটি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। গত এক বছরে নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির অভিযোগে করা মামলার দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যায়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে উল্লিখিত সময়ে দুই হাজারেরও বেশি মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস (জিএমপি) গাইড লাইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা এবং ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের দায়ে এ পর্যন্ত ৮৬টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। আর ১৮টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ ইতিবাচক। এটা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয় সাধারণত দু’টি পদ্ধতিতে। এর মধ্যে একটি হলো, শীর্ষ স্থানীয় বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ বোতল ও লেবেল লাগিয়ে নকল করা। অন্যটি পরিমাণ ও গুণগত মানের সঙ্গে আপস করে নিম্নমানের ওষুধ তৈরি। ফলে এসব ওষুধ ব্যবহারে কোন ফলাফল পাওয়া যায় না। অনেক সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। সুতরাং জনস্বাস্থ্যে নকল–ভেজাল ওষুধের প্রভাব কতটা বিরূপ তা সহজেই অনুমেয়। নকল বা ভেজাল রোধ করতে হলে ওষুধ প্রশাসনের নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। আবার শুধু নজরদারি বাড়ালে হবে না, একই সঙ্গে ভেজাল বা নকল ওষুধের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতাও বাড়াতে হবে। অন্যথায় এমন অপকর্ম রোধ করা কঠিন হবে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধে দেশের বিভাগীয় শহরসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মডেল ফার্মেসি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। ঢাকা, সিলেট নোয়াখালী খুলনায় পর্যায়ক্রমে ৩০টি মডেল ফার্মেসি ও সাতটি মডেল মেডিসিন শপ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ ভেজাল ওষুধ কিছুটা হলেও রোধে সহায়তা করবে বটে; তবে সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হলে শাস্তি না হওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেখা যাচ্ছে, অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসন অব্যাহতভাবে মামলা করছে। কিন্তু সে হিসেবে এগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না, শাস্তি দেয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান হচ্ছে না। দায়ীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত হলে সবার জন্য বার্তা দেয়াটা সহজ হবে যে, জীবনরক্ষার উপাদান ওষুধের মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস চলবে না। এতে আপনাতেই ভেজাল বা নকল ওষুধের বিস্তার অনেকাংশে হ্রাস পাবে। সুতরাং আমাদের প্রত্যাশা, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিপূর্বক নকল ওষুধ রোধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিতে দেরি করবে না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × three =