৬ লক্ষ একর সংরক্ষরিত বনাঞ্চলের বন্যাপ্রাণী বিলুপ্তির পথে ! ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পার্বত্যাঞ্চল ও কাপ্তাই হ্রদ

0
1459

চৌধুরী হারুনুর রশীদ,রাঙামাটি।
ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দেশের একদশমাংশ ভূমি বৃহত্তর পার্বত্যাঞ্চল। সংরক্ষরিত বনাঞ্চলও অভয়রন্য গুলোতে বন্যাপ্রাণী বিলুপ্তির পথে । রাঙামাটি বনসার্কেলে প্রায় ৬ লক্ষ রিজার্ভ ফরেষ্ট (সংরক্ষিত বনাঞ্চল) এর অধিকাংশ ভুমি বেদখল হয়ে গেছে। পার্বত্যঞ্চলের বন ও পরিবেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পিত উদ্যোগ না নিয়ে পৃথক বন আইনের পরির্বতনের ঘোষনা দিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন সরকার । প্রস্তাব অনুযায়ী অচিরেই নতুন বন আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।
এদিকে গত ৯ এপ্রিল ২০১৭ইঙ পৌরসভার সামনে বিজু, বৈসুক ও সাংগ্রাই উপলক্ষে শোভাযাত্রা উদ্ভোধনী বক্তব্যে বলেছেন ভুমি অধিগ্রহন আইনে সংশোধনে প্রস্তাব চাকমা সার্কেল চীফ দেবাশীষ  রায় । এ  আইনে সারাদেশে জমির ক্ষতিপুরুন মুল্য তিনগুণ করার কথা বলা হয়েছে ।এটা সকলের জন্য ভাল দিক । কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভুলে গিয়ে এ আইন করা হয়েছে। যাদের জমি বন্দোবস্তি আছে তারা ক্ষতিপুরুণ পাবেন কিন্তু যারা প্রথাগত নিয়মে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে,বনসংরক্ষণ,জুম চাষ করে আসছে তাদের জমি কি হবে ? তারা কি ক্ষতিপুরুণ পাবেন সি বিষয়ে উল্লেখ করা হয় নাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ থেকে বিষয়টি সরকারকে জাননো হয়েছে । আমরাও সরকারকে বলতে চায় সারাদেশের সাথে পার্বত্যঞ্চলকে এক না দেখে আইন সংশোধন করতে হবে। চাকমা সার্কেল চীফ আরো বলেন,১৯৫৮ সালে  অধিগ্রহন আইন দিয়ে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের আমলে কাপ্তাই বাধ দিয়ে রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি কিছু ডুবিয়ে দেয়া হয় । সেই সময়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা অধিকাংশ ক্ষতি পুরুণ পায়নি ।
সম্প্রতি রাঙামাটি জেলাপ্রশাসনের কার্য্যলয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বন জরিপ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে বলে জানাগেছে । ৩২০টি স্পটে  বা ব্লকে  চিন্থিত করা হয়েছে । তা হলো রাঙামাটি ১২৬টি বান্দরবান  ১১৭টি ও খাগড়াছড়ি ৭৭টি  । রাঙামাটি সদরে ৭টি  স্পটে জরিফ কার্যক্রম শুরু হবে জানাগেছে  ।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা এবং পাহাড়ধসের কারণে ক্রমাগত এ ভয়াবহ রূপ বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তারা আশংকা করে বলেছেন- বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশ বিস্ফোরন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যা ও পাহাড়ধসের কারণে এখানে প্রতিবছর অসংখ্য প্রাণহানিসহ কোটি কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। অতীতের তুলনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্বত্যাঞ্চলে বনজ সম্পদ উজার হয়ে যাওয়ার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি এখানকার অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
পরিবেশবাদীদের ধারণা- পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে ক্ষতিকর জুম চাষ (আদিম চাষবাদ পদ্ধতি), পাহাড় কেটে রাস্তাঘাট ও অপরিকল্পিত বাড়ি-ঘর নির্মাণ, আদা-হলুদ, কচু চাষ, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলণসহ কারণে অকারণে পাহাড় ও মাটি খননের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমাগত পাহাড়ধসের ঘটনা এবং পাহাড়ি ঢল ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অধিকহারে বাড়ছে। প্রতিবছর  কাচালং ,মাইনী ও কর্ণফুলী এ তিনটি নদী দিয়ে ভারত থেকে ঢল নেমে হ্রদের নিম্মঞ্চল ভরাট হয়ে যাচ্ছে।এখানে তিনটি সংস্থায় তিন ধরনের কাজ করে যেমন বিএফডিসি মৎস্য আহরণ প্রজনন ও বাজারজাতকরণ,কাপ্তাই হ্রদ পরিচালনা কমিটির কার্যক্রম হচ্ছে কয়েকবছর একবার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্য্যলয়ে সভা করা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এর কার্যক্রম তেম চোখে না পড়লেও জেলা প্রশাসকের বাংলোর পার্শ্বে কয়েকটি টাকার ভাঙ্গনরোধে পাথর বসিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলের বন্যায় অসংখ্য সরকারি ব্রীজ-কালভার্ট, পাকা-আধাপাকা ও কাঁচা রাস্তার প্রভূত ক্ষতিসাধিত হয়েছে। পার্বত্য এলাকার অপেক্ষাকৃত কম ঢালু পাহাড় নির্বাচন করে সেখানে গাছপালা ও লতাগুল্ম কেটে এবং পুড়িয়ে ফেলে জুম চাষ হয়ে আসছে। এসব কাজ হয়ে থাকে মূলতঃ বর্ষা মৌসুম শুরুর প্রাকমুহুর্তে। প্রাচীন পদ্ধতির এ চাষাবাদ করতে গিয়ে জুমচাষীরা নির্বিচারে বনজঙ্গল কেটে আগুনে পুড়িয়ে ফেলছে।
পরিবেশবাদীদের মতে, যত্রতত্র পাহাড় কেটে চাষাবাদ, রাস্তাঘাট ও অপরিকল্পিত বাড়ি-ঘর নির্মাণ, জঙ্গল কেটে আগুনে পুড়িয়ে জুমচাষের ক্ষেত্র প্রস্তুত, অবাধে বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধন, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন এবং বিভিন্ন কারণে পাহাড় ও মাটি খনন ইত্যাদির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল মারাত্মকভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে চলছে পাহাড় ও ভূমিধস। এসব ধস প্রতিবছর ভারি বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে প্রবাহিত হয়ে থাকে। বর্ষণে পাহাড় ও মাটি ধসের কারণে উপড়ে পড়ছে বৃক্ষ ও বনরাজি। এসব কারণে পাহাড়ে ভূমিধসের মাত্রা বেড়েছে। জনমনে বাড়ছে নানা উদ্বেগ, ভয়ভীতি ও আশংকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু রাঙ্গামাটি জেলায় ৫০ হাজার মানুষ ভূমিধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে। জেলার বিশাল কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির ৫০ বছরেও সংস্কার ও খনন হয়নি। খননের পরিবর্তে রাঙ্গামাটি শহরে বাস টার্মিনাল, ট্রাক টার্মিনাল, তবলছড়ি পুরাতন হাসপাতাল সংলগ্ন জানাযা মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে চলছে হ্রদ এলাকার জলাশয় ভরাট। এছাড়া দীর্ঘদিন যাবৎ বছর বছর বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ভূমিধস হওয়ায় ইতিমধ্যে সমগ্র হ্রদ এলাকা ভরাট হতে চলেছে। একই সঙ্গে দিনের পর দিন হ্রদে অসংখ্য বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা ত্যাগ করার কারণে দিনদিন বিষাক্ত হয়ে উঠছে কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জল। এতেও ভরাট হচ্ছে হ্রদের তলদেশ। ফলে ভারসাম্য হারাতে বসেছে কাপ্তাই হ্রদ এলাকার আশপাশের সমগ্র পরিবেশ।
পার্বত্য খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলায় বিশাল পাহাড় কেটে ইতিমধ্যে নির্মিত হয়েছে পাকা দালান-বাড়ি, রাস্তা এবং মাঠ-ঘাট। এসব কারণে রাঙ্গামাটি জেলাসহ অপর দু’টি পার্বত্য জেলাতেও অসংখ্য মানুষ বসবাস করছে পাহাড় ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে। প্রতিবছর জুম চাষের জন্য বিস্তীর্ণ পাহাড়াঞ্চল ধংসযজ্ঞের শিকার হতে থাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন হচ্ছে। জুমচাষের ফলে বন-জঙ্গলের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় এক সময়ের অভয়ারন্য এখন বিরানভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। ফলে বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হাতি, হরিণ, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, বানর, হনুমান ইত্যাদি প্রাণী  এখন এ বনাঞ্চলে নেই বললেই চলে। প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়জনিত কারণে বাসযোগ্য পরিবেশ হারিয়ে বন্য হাতিগুলো এখন অনেকটা উন্মাদ হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে জুমচাষ নিয়ন্ত্রিত পাহাড়ে গাছপালা ও বনজঙ্গল বিনষ্ট হতে থাকায় পরিবেশ হচ্ছে ভারসাম্যহীন। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমানে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে উল্লেখযোগ্য হারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষি বিজ্ঞানীদের হিসেব মতে প্রতিবছর পার্বত্য চট্টগ্রামে কমপক্ষে ৪০-৫০ হাজার হেক্টর পাহাড়ি ঢালু জমিতে জুমচাষ হয়ে থাকে। আর এ কারণে ওইসব এলাকা হতে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ফলে হেক্টর প্রতি ১শ থেকে আড়াইশ মেট্রিকটন মাটি ক্ষয় হয়ে থাকে। বৃষ্টির পানিতে পাহাড়ের এসব পলিমাটি ক্ষয়জনিত অবনয়নের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তিও হ্রাস পাচ্ছে। ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি বৃষ্টির পানিতে মিশে পাহাড়ি ঝর্ণা ও ছড়া হয়ে গড়িয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী ও বৃহত্তর কাপ্তাই লেক পর্যন্ত। পাশাপাশি বিশাল এ কাপ্তাই হ্রদ প্রায় ৫০ বছরে ড্রেজিং না করার ফলে পানি ধারন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে । ফলে মৎস্য প্রজনন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twelve − 3 =