আশার আলো চিকিতসায়

0
523

স্বাস্থ্য খাতে ২০১৭ সালটি ছিল বেশ আলোচিত। কিছু কিছু ঘটনা বছরব্যাপী আতঙ্কের পাশাপাশি ছড়িয়েছে অস্থিরতা। রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় ছিল চিকুনগুনিয়া আতঙ্ক, বিভিন্ন হাসপাতালে তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে চিকিতসক-রোগী হাতাহাতি, সরকারিভাবে দেশে টিকা দানের হার ৯৯ শতাংশ হলেও টিকা না পৌঁছানোয় সীতাকুন্ডে হামে ৯ শিশুর মৃত্যু, মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করলেও এখনো কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে না পৌঁছানো,

 

কক্সবাজারে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইচআইভি পজেটিভ- এইডসের আতঙ্ক, চিকিতসকদের প্রতি স্পষ্ট অক্ষরে রোগীর ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) লেখাহাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়া এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চালু করা কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের ১৪ হাজার চাকরি রাজস্ব খাতে না আসায় প্রকল্পের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা। এ ছাড়াও সরকারি চাকরিরত চিকিতসকদের বাণিজ্যিক মানসিকতা-স্বেচ্ছারিতা, রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহার, জিম্মি করে অর্থ আদায়, উপজেলার কর্মস্থলে না গিয়ে ঢাকা থাকার তদবিরসহ নানা কারণে চিকিতসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের কেটেছে অসন্তুষ্টিতে। এমনকি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ছিল এক ধরনের অস্থিরতা। স্বাস্থ্য খাতে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলেও বৃক্ষমানব আবুল বাজানদার, হাতে বিরল টিউমার আক্রান্ত মুক্তামনি, জোড়া লাগানো দুই বোন তোহা আর তহুরার পৃথক হওয়া, লিভার সিরোসিস ও ফেইলিউরে বাংলাদেশি চিকিতসকদের অভাবনীয় উদ্ভাবনসহ চিকিতসায় সাফল্য মানুষের মধ্যে অনেকটা আশার আলো ছড়িয়েছে। তাই সবকিছু ছাপিয়ে বছরব্যাপী সাফল্যের দিকগুলোই বেশি আলোচিত হয়েছে। পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া আতঙ্ক দূরীকরণসহ স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে বছরব্যাপীই গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে সরকারের প্রচারণার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবায় চরম নৈরাজ্য, চিকিতসকদের বাণিজ্যিক মানসিকতা-স্বেচ্ছারিতা, রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহার, জিম্মি করাসহ নানা কারণে চিকিতসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি আছে। স্বাবলম্বীরা পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে চিকিতসা নিচ্ছেন। সঠিক চিকিতসা না পাওয়ায় অনেকেই এখন বিদেশমুখী। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এত সব নেতিবাচক দৃষ্টান্তের ভিড়ে বাংলাদেশি চিকিতসকদের একাংশের পেশাগত আন্তরিকতা ও সাফল্য আশা জাগায় সাধারণ মানুষের মনে। তাই দেশের চিকিতসকেরা যদি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি না করে চিকিতসাসেবা এবং গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারেন, তাহলে রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কমে যেত বলে মনে করছেন তারা। পাশাপাশি চিকিতসকদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসত। গত বছরে স্বাস্থ্য খাতে অন্যতম সাফল্যের নাম আবুল বাজানদার। পুরো বিশ্বেই এখন পরিচিত এই নামটি। ‘বৃক্ষমানব’ অভিহিত করে এই যুবকের বিরল রোগ নিয়ে সংবাদ প্রচার করে বিশ্বের তাবত গণমাধ্যম। তবে সেই বিরল রোগের প্রকোপ থেকে বাজানদার এখন অনেকটাই মুক্ত। এখনো চিকিতসাধীন থাকলেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন। এ ক্ষেত্রেও কৃতিত্ব ঢাকা মেডিক্যালের সংশ্লিষ্ট চিকিতসকদের। তোহা আর তহুরা- দুই বোন এখন একে অন্যের চেহারা দেখতে পায়। মায়ের কোলে বসে মিটিমিটি হাসে একজন আরেকজনকে দেখে। গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয় বিচ্ছন্ন করার পর সুস্থ জোড়া শিশু তোহা ও তহুরাকে। মাত্র ক’দিন আগেও দু’জনের শরীর ছিল একসাথে জোড়া লাগানো। কোমরের পেছনের দিকে একে অন্যের সাথে যুক্ত থাকায় দু’জনের শরীরে পায়খানার রাস্তা ছিল একটি। এ ছাড়া মেরুদন্ডও যুক্ত। অত্যন্ত জটিল এই শারীরিক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া নিয়ে ছিল সংশয়। উভয়কে বাঁচিয়ে অস্ত্রোপচার সম্ভব কি-না এ নিয়ে বিশেষজ্ঞা চিকিতসকরা দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোহা ও তহুরাকে সুস্থভাবে আলাদা করতে সক্ষম হন ঢাকা মেডিক্যালের সার্জারি বিভাগের চিকিতসকেরা। সেলাই কাটার দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দু’বোন এখন সুস্থ আছে। চিকিতসকরা জানান, এখন স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বেড়ে উঠবে দুই বোন। অথচ ওদের আগে পৃথিবীতে এ ধরনের শিশু ১৩টি শিশু জন্মগ্রহণ করেন। যাদের ৬০ ভাগই অস্ত্রোপচার পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করে। দেশে মুক্তামনির নাম না জানা মানুষ এখন আছে কি-না সন্দেহ। কিশোরী এই মেয়েটিও বাংলাদেশে চিকিতসা সাফল্যের একটি দৃষ্টান্ত। সিঙ্গাপুরের নামকরা একটি হাসপাতাল বলে দিয়েছিল, তার হাতের বিরল টিউমারটি কেটে সরানো সম্ভব নয়। এরপরও হাল ছেড়ে দেয়া পরিবার তাকে দেশে নিয়ে আসে। কিন্তু ঢাকা মেডিক্যালের চিকিতসকরা হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে সফল অপারেশনের মাধ্যমে টিউমারটি অপসারণ করে পুরো হাতে চামড়া লাগানো হয়েছে। এখন বেঁচে থাকার স্বপ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে মুক্তামনির চোখে।

২০০ বছর পর কলেরার জীবাণু নিয়ন্ত্রণের কৌশল রপ্ত

২০০ বছর আগে ১৮১৭ সালে পৃথিবীর বৃহত ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে এক মহামারি রোগের আবির্ভাব ঘটেছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেইসময় সুন্দরবন এলাকায় হাজার হাজার শ্রমিক পাঠায়। যাদের দায়িত্ব ছিল বিস্তীর্ণ বনভ‚মি পরিষ্কার করে চাষাবাদ উপযোগী করা। কিন্তু কে জানত এই লোনা জলে ভাইবারিও কলেরা নামক ব্যাকটেরিয়ার আবাসস্থল। এই ব্যাকটেরিয়া এসব ব্রিটিশ কর্মীদের শরীরের অন্ত্রে প্রবেশ করে ভেতর থেকে সবকিছু তরল করে বের করে দিতে শুরু করে। এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এসব ব্রিটিশ কর্মীদের শরীরে চরম পনিশূন্যতা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তাদের হার্টবিট দুর্বল হয়ে পড়ে, ইলেকট্রোলাইটের চরম ঘাটতি দেখা দেয় এবং ছয় ঘণ্টার মধ্যে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তখনকার চিকিতসাকরা এ রোগের কুলকিনারা করতে না পারলেও ২০০ বছর পরে বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি এ রোগের সফল ও গ্রহণযোগ্য টিকা আবিষ্কার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে যে চিকিতসাব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে তা এতই কার্যকর যে, এটি এ রোগে আক্রান্ত মানুষের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশের জীবনরক্ষা করতে সক্ষম।

লিভার সিরোসিস ও ফেইলিউরে বাংলাদেশি চিকিতসকদের অভাবনীয় উদ্ভাবন

লিভার সিরোসিস অথবা অন্য কোনো কারণে লিভার অকার্যকর (ফেইলিউর) হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত- এমন ধারণা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের দুই বিজ্ঞানী। সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে মৃত্যু অবশম্ভাবী এসব রোগের চিকিতসায় অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন তারা। লিভার (যকৃত) ফেউলিউর রোগীদের নতুন পদ্ধতির এই চিকিতসা শুরু করেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)। তাকে সব ধরনের পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছেন জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। ইতোমধ্যে এই দুই চিকিতসকের আবিষ্কার ন্যাসভ্যাক ওষুধ এবং স্টেমসেল চিকিতসাপদ্ধতি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

গবেষণা ও চিকিতসা ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক উন্নতি সাধন করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। স্পেনভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে এ তথ্য উঠে এসছে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী ভারতীয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে অনেক ধাপ ওপরে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। তা ছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই শুরু হয়েছে দেশের প্রথম স্টেমসেল থেরাপির মাধ্যমে লিভার চিকিতসাব্যবস্থা।

 

 

হার্টের ভাল্ব, স্ট্যান্ট ও পেসমেকারের দাম নির্ধারণ

এ বছরের দেশে প্রথমবারের মতো করোনারি স্ট্যান্ট বা হার্টের রিং, ভাল্ব এবং পেসমেকারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করেছে সরকার। বছরের মাঝামাঝি স্ট্যান্টের দাম কমানো হয় এবং ১৯ ডিসেম্বর ভাল্ব ও পেসমেকারের দাম নির্ধারণ করে অধিদফতর। এতে করে রোগীরা অগের তুলনায় অনেক কম দামে জীবন রক্ষাকারী এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারছে। এসব উদাহরণ মাত্র গত কিছুদিনের। এর বাইরেও অতীতে অনেক বিরল রোগের চিকিতসা ও গবেষণায় সাফল্যে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের চিকিতসকেরা। এই সাফল্য আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে চিকিতসকদের। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, বিদেশ থেকে হতাশ হয়ে ফিরে আসা রোগী যখন আমাদের চেষ্টায় স্বাভাবিক জীবন পাচ্ছেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, আবুল বাজানদার, তোহা ও তহুরা এবং মুক্তামনিকে নিয়ে চিকিতসকদের সফলতার খবর জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে সফলতা নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বইয়ে এদের ছবি এবং চিকিতসা করা চিকিতসকদের নিয়ে সাকসেস স্টোরি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বলেন, গত বছর ছিল আমাদের সাফল্যের বছর। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের জন্য বছরটি একটি প্রাপ্তির বছর। তিনি বলেন, যে ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত এগিয়ে চলছে তা অত্যন্ত ইতিবাচক।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × 3 =