পরপর দুটো আঘাতে দেশের ক্রিকেটে টালমাটাল অবস্থা

2
780

ভারতের ধর্মশালায় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে তাসকিন আহমেদ এবং আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন দুই আম্পায়ার। এমন একটা সময় এই ঘটনাটা ঘটেছিল যখন কিনা বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ক্রিকেট বিশ্ব। কিছুদিন আগেই এশিয়া কাপ ফাইনালে ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপকে নাকানি চুবানি খাইয়েছিল টাইগাররা। তারপর ভারতেও এর পুনরাবৃত্তি চলছিল।

অন্য বোলারদের সাথে তাসকিন-সানিও ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। তাদের বল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ভারতের ব্যাটসম্যানরা। ঠিক সেই সময়টাতেই আসলো জোড়া আঘাত।

তাসকিন-সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন খোদ ভারতের আম্পায়ার সুন্দরম রবি। অথচ এর আগে তাসকিন সারা বিশ্ব খেলে আসলো। কোথাও কেউ তার অ্যাকশনে কোনো সমস্যা পেল না। হঠাৎ করে ভারতই পেল সমস্যাটা। শুধু এটাই নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তারকা পতনের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে সেখানে কোনো না কোনোভাবে চলে আসছে ভারতের যোগসূত্র। সর্বশেষ সাকিব কেলেংকারিও এর ব্যাতিক্রম নয়।

ক্রিকেটারদের আন্দোলন, এরপর সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞা। পরপর দুটো আঘাতে দেশের ক্রিকেটে টালমাটাল অবস্থা। এমন সময় এই পরিস্থিতি তৈরি হলো যখন কিনা ভারত সফরের জন্য দল সাজাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসছে যে, দেশের ক্রিকেটের এই স্থবিরতায় কি হাত আছে ভারতের? যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা কতটা?

আবারও ফিরে যাই একটু পেছনে। ২০১৬ এর মার্চে তাসকিন-সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর তারা কিন্তু ঠিকই ফিরে এসেছিল। কিন্তু তাদের সেই ধারটা আর কিছুতেই ফেরেনি। দলে এখন নখ দন্তহীন বাঘ হয়ে আছেন তারা।

২০১৬ সালেই মোস্তাফিজুর রহমানকে নেওয়া হলো আইপিএল এ। দুই বছর সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেললেনও তিনি। এরমধ্যে প্রথমবারেই ১৭ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে আসরের উদীয়মান তারকার পুরস্কার পেলেন। কিন্তু যা পেলেন খোয়ালেন তারচেয়ে অনেক বেশি। আইপিএল ফিজকে এমন ইনজিউরড বানালো যে, আগের সেই তেজটা তিনি আর ফিরে পেলেন না।

এর আগে, মাশরাফি বিন মর্তুজাকেও নিয়েছিল আইপিএল। কিন্তু সেখানে ম্যাচের পর ম্যাচ তাকে বসিয়ে রেখে মনোবলটাই ভেঙে দেওয়া হলো। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তারকা খেলোয়াড়দের নখদন্তহীন হওয়ার যে ঘটনা এর সবগুলোতেই কেন ভারতের যোগসূত্র? এর পেছনে কী রয়েছে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র?

সাকিবের দোষ কতটুকু, সে কম নাকি বেশি শাস্তি পেল তা নিয়েও চলছে নানা তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু একটা বিষয় কিছুটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। তা হলো, যে জুয়াড়ির সাথে যোগাযোগের কারণে সাকিব ফাঁসলো সে কিন্তু ভারতীয়। জুয়াড়ির সাথে কথপোকথন লুকিয়ে সাকিব অবশ্যই ভুল করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যসব তারকা পতনের মতো সাকিবের ঘটনাটাতেও এক ভারতীয়ের যোগসূত্র প্রশ্ন জাগাচ্ছেই যে, এর পেছনে অন্য কিছু নেই তো?

যে তিনটি ম্যাচ পাতানোর জন্য সাকিব আল হাসান প্রস্তাব পেয়েছিলেন তার একটি ছিল আইপিএলের। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে তার বিরুদ্ধে আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের তদন্তে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ভূমিকা আদৌ আছে কিনা। জানা গেছে, সাকিবের সাথে আগেও যোগাযোগ করেছিল জুয়াড়িরা। সে সময় তিনি আকসুকে এ বিষয়ে জানিয়েছিলেন। কিন্তু আইপিএল এর সময় যখন দীপক আগড়ওয়াল নামের জুয়াড়ি তার সাথে যোগাযোগ করলো সেটা কেন সাকিব চেপে গেলেন?

আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিট এ বছরের জানুয়ারি এবং আগস্টে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সাকিবের সাথে জুয়াড়ির যোগাযোগের ঘটনাটাও বেশ পুরোনো। একটা ২০১৭ এর। আরেকটা ২০১৮ তে জিম্বাবুয়ে-শ্রীলঙ্কা টেস্টের সময়ের। আইসিসির কাছে বহু আগে থেকেই এর তথ্য ছিল। তাহলে এত সময় পরে একেবারে ভারত সফরের আগেই কেন এই নিষেধাজ্ঞা?

এর সঙ্গে কী আগামী বছর টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপেরও কোনো যোগসূত্র আছে? এমনভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে যেন বিশ্বকাপটাও সাকিব মিস করেন। প্রশ্ন আছে আরও। সাকিবকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল আইসিসি। তার মানে কি সাকিব আগেই জানতেন যে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে যাচ্ছে? সব জেনে বুঝেই কি তিনি ক্রিকেটারদের আন্দোলন উস্কে দিয়েছিলেন?

সাকিব আইপিলে খেলেন এবং সেখানে বিপুল পরিমাণ টাকাও পান তিনি। বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলে যে টাকা পাওয়া যায়, আইপিএল এ একটা সিজন খেললেই তার চেয়ে এক দেড় গুণ বেশি কামানো যায়। এজন্যই কি সাকিব ভারতীয়দের বশ্যতা স্বীকার করে পুরো ঘটনাটা চেপে গিয়েছিলেন এমন প্রশ্ন করছেন অনেকে।

অনেক ক্রিকেটারই জানিয়েছেন, ভারতে বুকিদের সাথে ক্রিকেটারদের এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয় যেটা ফাঁদে না পড়লে বোঝার উপায় থাকে না। কাউকে নায়িকা দেওয়া হয়। কাউকে অন্যভাবে বশে আনা হয়। একটা পর্যায়ে দেখা যায় যে, তাদের আর খেলার দিকে কোনো মনোযোগই থাকে না। গত আইপিএল এ সাকিবকে পুরোটাই বসিয়ে রাখা হয়েছিল।

তিনি যেন প্রাকটিস করতে পারেন এজন্য বাংলাদেশে সাকিবের কোচ মো. সালাউদ্দিনকে উড়িয়ে ভারতে নেওয়া হয়েছিল। গুরুর তত্ত্বাবধানে সেখানে অনুশীলন করেছিলেন সাকিব। পরবর্তীতে সাকিব জানান যে, আইপিএলের জন্যই তিনি বিশ্বকাপে ভালো করেছেন। এই কথার মাধ্যমে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় আইপিএল এ সাকিবের দল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের প্রতি তিনি কতটা বিশ্বস্ত।

বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন বারবার বলছিলেন, ভারত সফর বানচাল করার জন্য চেষ্টা করছে একটি চক্র। এ বিষয়ে তার কাছে তথ্যও আছে। কিন্তু কী সেই তথ্য, তিনি কেন তা প্রকাশ করছেন না সেটা নিয়েও আছে রহস্য।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে চলমান পরিস্থিতিতে আরেকজন ব্যক্তির দিকে যাচ্ছে সন্দেহের তীর। তিনি লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের মালিক লুৎফর রহমান বাদল। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে শুরু করে শেয়ার বাজারেও এক বিতর্কের নাম এই বাদল। তার ক্লাব রূপগঞ্জে একসময় খেলেছেন সাকিব।

নেপালে তার ব্যাংক আছে। ভারতেও আছে ব্যবসা। ভারত-নেপাল নিয়মিত যাতায়াত তার। ভারতীয় ক্রিকেটের বড় বড় কর্তাদের সঙ্গেও তার ওঠাবসা আছে। সাকিবের সাথে এখনও তার যোগাযোগ আছে বলে দাবি করছে কয়েকটি সূত্র। সন্দেহবাদীরা এটাও বলছেন যে, ভারতীয়দের সাথে আঁতাত গড়ে এই লোকই কি কোনোভাবে ফাঁসিয়েছেন তাকে? উত্তর যেটাই হোক না কেন সাকিবের মতো অভিজ্ঞ একজন ক্রিকেটার এরকম গুরুতর একটি বিষয় গোপন করবেন এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই।

বলা হচ্ছে, সাকিব এক বছর পর খেলায় ফিরবেন। কিন্তু সেই ফেরাটাকে কি আর ‘ফেরা’ বলা যাবে? ‘বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ’ সাকিব আল হাসানের পুরনো ধার কি এক বছর পর আর থাকবে? যেকোনো পেশার মানুষকে যদি দীর্ঘ সময় তার কাজের বাইরে রাখা হয় তাহলে সে তার কাজটা কিছুটা হলেও ভুলে যায়।

দুর্দান্ত ট্যালেন্টেড মানুষও দীর্ঘ বিরতির পর নিজের কাজে ফিরলে আগের দক্ষতা ফিরে পেতে তাকে সংগ্রাম করতে হয়। আর এটা তো ক্রিকেট। যেখানে সার্বক্ষনিকভাবে প্রাকটিসের মধ্যে থাকতে হয়। তাছাড়া এখানে বয়সও একটা বড় বিষয়। ৩২ বছরের সাকিব এক বছর পর ফিরে এসে নিজেকে কতটুকু মেলে ধরতে পারবেন সেটাও এক বড় প্রশ্ন। এ যেন দীর্ঘ পরিকল্পনার পর এক বাঘকে খাঁচাবন্দি করার চিত্র।

ক্রিকেট বিশ্লেষকদের একটা অংশ বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারকা পতনের যত ঘটনা ঘটেছে এর সিংহভাগেই পাওয়া যাবে ভারতের যোগসূত্র। ভারতের জন্য যারা হুমকি হয়ে উঠেছিল, কোনো না কোনোভাবে তাদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধীরে সুস্থে মাস্টার প্ল্যান করেই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটকে ধ্বংস করেছে ভারত। পাকিস্তানের ক্রিকেটও ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন তারকা ক্রিকেটারও ভারতের এই থাবা থেকে বাঁচতে পারেনি।

আইপিএলের কোটি টাকার ঝনঝনানি আর ঝলমলে বিনোদন দুনিয়ার ডাক- এরপর ইনজুরি, ফর্ম হারিয়ে ফেলা। এই পথে না হলে অবৈধ বোলিং অ্যাকশন আর ফিক্সিং। দুর্ধর্ষ সব ক্রিকেটারদের ধারহীন বানিয়ে ফেলার মোক্ষম উপায় হয়ে উঠেছে এগুলো। সাকিব আল হাসান এই জালমুক্ত হয়ে স্বরূপে ফিরতে পারেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

20 − 3 =