নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের দৈর্ঘ্য ১১.৬০ কিলোমিটার। এই ১১ কিলোমিটার রাস্তায় প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী এবং পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের ছত্রছায়ায় জড়িত রয়েছে অর্ধশত লাইনম্যান। যানবাহনের কাগজপত্র ও মালামাল তল্লাশির নামে এসব চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমে শহর রক্ষা বাঁধের পুরান ঢাকার মিটফোর্ড বাবুবাজার থেকে গাবতলীর দূরত্ব ১১.৬০ কিলোমিটার। দীর্ঘ এ পথে প্রতিদিন কয়েক হাজার পণ্য ও যাত্রীসহ বিভিন্ন পরিবহণ চলাচল করে। নগরীর তীব্র যানজট এড়াতে দ্রুততম সময়ে পুরান ঢাকার আদালত চত্বর, শিক্ষা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পাইকারি কাপড়, মাছ-ফলের আড়তসহ বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছতে পরিবহণ মালিক-চালক ও যাত্রীরা দীর্ঘ এ পথ নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করেন। নগরবাসীর চাহিদা মেটাতে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এ পথ দিয়ে প্রতিদিন দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে নগরীর ঐতিহ্যবাহী পাইকারি মার্কেট মৌলভীবাজার, বাবুবাজার, ইসলামপুর প্রবেশ করছে। এছাড়া পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর হওয়ার পর থেকেই দীর্ঘ এ পথে দর্শনার্থী ও যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। নগরীর অভ্যন্তরীণ সড়কের ভয়াবহ যানজট এড়াতে ও অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে গণপরিবহণের সংখ্যাও বেড়েছে। যাত্রী ভোগান্তি কমাতে কয়েক ধাপে বিভক্ত করে যাত্রী পরিবহণের সংখ্যা বাড়িয়েছেন পরিবহণ মালিকরা। এর মধ্যে শহর রক্ষা বাঁধে সাভার থেকে বাবুবাজার (ভায়া গাবতলী) রুটে ২০টি যানযাবিল, ৪০টি ব্রাদার্স ও ৩০টি প্রত্যয় পরিবহণ নামে সর্বমোট ৯০টি বাস প্রতিদিন চলাচল করছে।
এছাড়া গাবতলী থেকে হাজারিবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ রুটে ফিটনেসহীন হিউম্যান হলার (চ্যাম্পিয়ন পরিবহণ) নামে প্রায় ৭০টি লক্কড়-ঝক্কড় মিনিবাস, মোহাম্মদপুর থেকে নবাবগঞ্জ সেকশন রুটে সরকার নিষিদ্ধ ৫৬টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার থেকে নবাবগঞ্জ সেকশন রুটে ৬৫টি সিএনজি অটোরিকশা, নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ থেকে মিটফোর্ড বাবুবাজার রুটে নিয়মিত প্রায় ৩০টি লেগুনা ও বাবুবাজার ব্রিজের উপর-নিচ থেকে জুরাইন, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীসহ ১০টি রুটে প্রায় ৩শ যাত্রী পরিবহণ চলাচল করছে। অপরদিকে এ পথে প্রতিদিন পণ্যবাহী সহস্রাধিক ট্রাক-কভার্ডভ্যান ও পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শহর রক্ষা বাঁধে গাবতলী থেকে মিটফোর্ডের বাবুবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ ১১.৬০ কি.মি. পথ ডিএমপি’র ৮টি থানার অধীনে থাকায় সংশ্লিষ্ট থানা-ফাঁড়ি পুলিশ ও শাসক দলের কথিত নেতাকর্মী এবং চিহ্নিত চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কাছে রীতিমতো জিম্বি হয়ে পড়েছেন পরিবহণ মালিক-চালক ও শ্রমিকরা।
এক লেগুনার মালিক তার পরিচয় গোপন রাখা শর্তে চাঁদাবাজির বিষয়টি উল্লেখ করে জানান, পুলিশ ও শাসক দলের নেতাকর্মী এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে চাঁদা না দিয়ে কোনো পরিবহণ এ রুটে ঠিকমত চলাচল করতে পারে না। স্থানীয় এক সংসদ সদস্যের ভাগ্নে লেগুনা থেকে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা হারে মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। দৈনিক ভিত্তিক চাঁদার টাকা সরাসরি পৌঁছে না দিলে লেগুনা চালাতে দেয়া হয় না। এক কাউন্সিলর প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা হারে মাসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। এছাড়া ইসলামবাগের কথিত যুবলীগের এক নেতা এসব লেগুনা থেকে নিয়মিত মোটা অংকের চাঁদা তোলেন।
এদিকে মিটফোর্ডের বাবুবাজার বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নিচে গাবতলী থেকে বাবুবাজার রুটে চলাচলকারী ব্রাদার্স, যানযাবিল ও প্রত্যয় নামের পরিবহণ থেকে লাইনম্যান হিসেবে পুলিশ ও শাসক দলের নেতাকর্মীরা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে চাঁদা তুলেন। গড়ে প্রতিদিন ৯শ টাকা হারে মাসে ২৭ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া বংশাল ও কোতোয়ালি থানাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার দু’ফাঁড়ি পুলিশের জন্য গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা হারে মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়াও ব্রিজের নিচে অবৈধ ফুটপাতের দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার টাকা হারে মাসে ৯ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন এক লাইনম্যান। এসব ফুট দোকানির মধ্যে রয়েছে টং, চায়ের স্টল, রিকশার গ্যারেজ, পাইকারি চালের গোডাউন ও ভাঙ্গারি দোকানপাট। লেগুনা থেকে কোতোয়ালি থানার সাবেক ছাত্রলীগের এক নেতা গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ও ব্রাদার্স পরিবহণ থেকে ৪শ টাকা করে চাঁদা আদায় করেন। তার পক্ষে চাঁদা তোলেন ক্যাডার হিটলার।
এছাড়া বাবুবাজার থেকে জুরাইনসহ ১০টি রুটে চলাচলরত বিভিন্ন যাত্রী পরিবহণ থেকে লালবাগ-কোতোয়ালি জোনে কর্মরত ২৭ জন ট্রাফিক সার্জেন্টের জন্য প্রতি সপ্তাহে মোটা অংকের চাঁদা তোলা হয়। বর্তমানে এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নবনিযুক্ত এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে চকবাজার-মিটফোর্ড সড়কসহ অলিগলিতে কয়েক হাজার হকার বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। এসব দোকান থেকে লাইনম্যান দ্বারা প্রায় ৮০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। ঐ লাইনম্যানের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আরো ৬/৭ জন লাইনম্যান। ব্রিজের নিচে ফুট দোকান থেকে ৩০ টাকা হারে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন পরিবহণের লাইনম্যান মানিক।
নবাবগঞ্জ সেকশন থেকে খোলামোড়া, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার রুটে ও নবাবগঞ্জ সেকশন পুলিশ ফাঁড়ি থেকে গুলিস্তান রুটে ৫ শতাধিক যাত্রী পরিবহণ থেকে কামরাঙ্গীরচরের প্রভাবশালী এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর, হাজারিবাগের এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর, আদাবরের ডিএনসিসি’র ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও তাদের ক্যাডার বাহিনী যাত্রী পরিবহণ থেকে গড়ে প্রতিদিন ১ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন।
৫টি রুটে ৩ শতাধিক যাত্রী পরিবহণের মধ্যে নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ থেকে খোলামোড়া রুটে সরকার নিষিদ্ধ ২৫টি থ্রি-হুইলার টেম্পো, ৫৪টি অটোরিকশা, মোহাম্মদপুর রুটে চলাচল নিষিদ্ধ ১৬৪টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার রুটে ৫০টি সিএনজি অটোরিকশা, গাবতলী রুটে চ্যাম্পিয়ন পরিবহণ নামে ৬৮টি হিউম্যান হলার, গুলিস্তান রুটে ১২৭টি লেগুনা ও চকবাজার থেকে সেকশন রুটে ৩৭টি সিএনজি অটোরিকশা নিয়মিত চলাচল করছে। এসব রুটের প্রতি পরিবহণ থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪৫ হাজার ৫শ ৬০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের কয়েকজন মালিক-চালক জানান, দ্রততম সময়ে পুরান ঢাকার যাত্রীদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই তারা শহর রক্ষা বাঁধের এ রুটটি বেছে নেন। কিন্তু দীর্ঘ এ পথে ৮ থানা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং শাসক দলের কথিত নেতাকর্মীদের হাতে রীতিমতো তারা জিম্বি হয়ে পড়েছেন। চাঁদা না দিলে এ পথে তাদের পরিবহণ চলাচলে নিয়মিত প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে, গাড়ির কাগজপত্র তল্লাশির নামে সংশ্লিষ্ট থানা-ফাঁড়ি ও ট্রাফিক পুলিশের চরম হয়রানি।
শহর রক্ষা বাঁধে নিয়মিত চলাচলকারী দূরপাল্লার ট্রাক ও কভার্ডভ্যানে কয়েকজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে শহর রক্ষা বাঁধ দিয়ে পুরান ঢাকার পাইকারি বাণিজ্যিক কেন্দ্র মৌলভীবাজার, চকবাজার, সোয়ারিঘাট, মিটফোর্ড, বাবুবাজার ও ইসলামপুরে যাতায়াত করেন। গাবতলী থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এ পথে ১৬টি পয়েন্টে সংশ্লিষ্ট থানা ও ফাঁড়ি পুলিশকে পণ্যের প্রকারভেদে সর্বনিম্ন ৫শ হতে ১৫/২০ হাজার টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় পণ্য ও যানবাহনের কাগজপত্র তল্লাশির নামে বৈধ জিনিসকেও অবৈধ বলে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়।
এ ব্যাপারে ডিসি ট্রাফিক (দক্ষিণ) বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।