যে শহরে বাবার ছড়াছড়ি

0
588

কক্সবাজার শহরের পূর্ব রাখাইনপাড়া। গত শনিবার দুপুরে সেখানে রাস্তার পাশের একটি গলির মুখে আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর মধ্যবয়সী এক নারী পাশে এসে দাঁড়ান। ক্ষীণ স্বরে বলেন, ‘বাবা’ লাগবে? সবুজ গোলাপি লাল সব আছে। ১০০ টাকা লাগবে। নিলে জলদি করতে হবে, বেশিক্ষণ

দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না জানিয়ে দেন ওই নারী। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি বলেন, এখানে দাঁড়িয়ে কাজ কী, সব জায়গায় তো ‘বাবা’র ছড়াছড়ি।ঝামেলা এড়াতে মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবা বড়িকে এখন কক্সবাজার শহরে বাবা নামে বিক্রি করেন। শহরের অন্তত ২২টি স্থানে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা ও পুরিয়া (হেরোইনের সঙ্গে নেশা-জাতীয় বড়ি মিশিয়ে তৈরি করা হয়)। পূর্ব রাখাইনপাড়ায় মাদক কেনার প্রস্তাব পাওয়ার পর সেখান থেকে ৩০০ গজ দূরে বাজারঘাটার পৌরসভা মার্কেট-সংলগ্ন রাখাইনপাড়ায় যান এই প্রতিবেদক। রাস্তায় ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর এক ব্যক্তি পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চান কারও জন্য অপেক্ষা করছি কি না। কেউ মাদক কেনার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসবে না। তিনি বলেন, এই গলিতে সব সময় ইয়াবা বিক্রি চলে। এখানে রাস্তার পাশের কয়েকটি টং দোকানে (চায়ের দোকান) গাঁজা-হেরোইনও বিক্রি হয়। ইয়াবায় আসক্ত ওই তরুণদের অনেকে শহরের অলিগলিতে চুরি-ছিনতাইয়েও জড়িত। রাখাইনপাড়ায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে বিকেল চারটার দিকে হেঁটে ৩০০ গজ দূরে বড়বাজারের একটি গলির মুখে গিয়েই এক ব্যক্তিকে ঘিরে তিন-চারজন যুবকের জটলা দেখা গেল। পরে দেখা গেল ঘটনাটি মাদক বেচাকেনার নয়। চারজনই একসঙ্গে চলে গেল। ধরা পড়ার ভয়ে সাধারণত মাদকের ক্রেতা-বিক্রেতা একসঙ্গে যান না। সেখানে বসা এমন একজন পরিচিত যুবককে খুঁজে বের করে তাঁর কাছে মাদক বিক্রেতাদের তথ্য জানতে চাইলাম। ওই যুবক দেখিয়ে দিলেন লুঙ্গি ও শার্ট পরা এক ব্যক্তিকে। পরে জানা গেল তাঁর নাম আবদুল জব্বার। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ম্যানেজ (ব্যবস্থা) করেই এসব চলে।’ শহরে মাদক বিক্রির জন্য পরিচিত তিনটি এলাকা ঘুরে এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অপরিচিত মুখ (পর্যটক), ১৬-১৭ বছরের কিশোর থেকে শুরু করে ৩৫-৩৭ বছরের তরুণদের কাছেই মূলত ইয়াবা ও পুরিয়া বিক্রি করা হয়। বিক্রেতারা বলেন, অপরিচিত কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট গলিতে এলে তিনি মাদকসেবী কি না, তা সহজেই ধরতে পারেন তাঁরা। এলাকায় ওই ব্যক্তির অবস্থান ও আচরণ বুঝেই মাদক কেনার প্রস্তাব দেন তাঁরা। বেশির ভাগ সময়েই তাঁদের (মাদক বিক্রেতা) ধারণা ঠিক হয়। নিয়মিত মাদক না নিলেও কক্সবাজারে বেড়াতে এসে শখ করে বা কৌতূহলবশত অনেকে ইয়াবা কিনতে আসেন। তাঁদের কাছ থেকে দাম বেশি রাখা হয়। কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, শহরের বাজারঘাটা, পূর্ব রাখাইনপাড়া, পশ্চিম রাখাইনপাড়া, বৈদ্যঘোনার মোড়, পাহাড়তলী, ইসলামপুর খেলার মাঠ, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, কলাতলীর মোড়, সুগন্ধা পয়েন্ট, ঝাউবাগান, হোটেল গেস্টহাউস এলাকা, হলিডের মোড়, বাহারছড়া মোড়, ঝাউতলা, কবরস্থান সড়ক, সমিতি বাজার, রুমালিয়াছড়া, গোলদীঘিরপাড়, লালদীঘিরপাড়, হাসপাতাল সড়ক, টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকাসহ ২২টি স্থানে মাদকের বেচাকেনা চলে। দুই শতাধিক ব্যক্তি এসব এলাকায় খুচরা পর্যায়ে মাদক বিক্রি করেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৩০ জন নারী। রাখাইনপাড়ায় মাদক বিক্রির রীতিমতো হাট বসে বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে মাদকসহ কিছু ক্রেতাকে ধরলেও মূল হোতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেয়রের দাবি, আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বড়বাজারের পূর্ব ও পশ্চিম রাখাইনপাড়া, টেকপাড়ার হিন্দুপাড়া ও হাঙ্গরপাড়ায় ইয়াবা বেচাকেনা বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু কিছু হয়নি। এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক মাঈন উদ্দিন বলেন, শহরের কয়েকটি এলাকা থেকে মাদকের আখড়া উচ্ছেদ করেছেন তাঁরা। মাদকের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযান চলবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৮২ হাজার। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। শহরের বাইপাস সড়কের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র নোঙর-এর নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ বলেন, গত ১০ বছরে ইয়াবায় আসক্ত প্রায় ৫ হাজার ব্যক্তি তাঁদের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। তাঁদের অনেকে এখন স্বাভাবিক জীবন কাটচ্ছেন। তাঁদের নিরাময় কেন্দ্রে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন ইয়াবায় আসক্ত ৫০ ব্যক্তি। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নৌপথে এবং উখিয়া থেকে স্থল ও নৌপথে অবৈধভাবে প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান ঢুকছে এই তথ্য এখন আর অস্বীকার করেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। গত শুক্রবার মাত্র ২০ ঘণ্টার মধ্যেই টেকনাফ ও কক্সবাজারে র‍্যাব এবং বিজিবির পৃথক অভিযানে জব্দ করা হয়েছে ১২ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা। কক্সবাজার হয়েই ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 × five =