মাহাম্মদী খানমের নানা অপকর্ম পরিচালকদের মনোরঞ্জন করে বাগিয়ে নিলেন ১০ বোনাস, কোটি টাকার গাড়ি

0
1416

দুর্নিতী আর প্রতারণার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদী খানমের বিরুদ্ধে প্রতারণা জালিয়াতির পর এবার উঠলো চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। দক্ষতার অভাবে দেশের বিভিন্ন শাখা বন্ধ হয়ে গেলেও ডুমুরে ফুলের সাফল্য দেখিয়ে ২০১৬ সালে পেয়েছেন ১০ ইনসেনটিভ বোনাসের পাশাপাশি কোটি টাকা মূল্যের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি। এক্ষেত্রে কয়েকজন ক্ষমতাশালী পরিচালকদের মনোরঞ্জনে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন মোহাম্মদী খানম, বলে অভিযোগ তুলেছেন কয়েকজন বিনিয়োগকারী। শুধু তিনিই নন, জড়িয়ে পড়েছেন অনেক পরিচালকগণ। ফলে তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এখন উঠেছে নানা গুঞ্জন। এ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে কয়েকজন পরিচালক ও তাদের পরিবার।
জানা যায়, ২০১৬ অর্থবছরে কোম্পানি গ্রোস প্রিমিয়াম ও নিট প্রিমিয়াম একেবারেই কমে গেছে। অন্যদিকে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধও করতে পারেনি উল্লেখযোগ্য হারে। যে কারণে হ্রাস পেয়েছে কোম্পানির আয়। লভ্যাংশ দিতে গিয়ে ভাঙতে হয়েছে এফডিআর। ফলে কমে গেছে বিনিয়োগ ও মোট সম্পদের পরিমাণ। কোম্পানির এমন হীন পরিস্থিতির কারণে পুঁজিবাজারে শেয়ারপ্রতি আয় হ্রাস পেয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রামসহ দেশে অন্যান্য অঞ্চলের বেশ কয়েকটি শাখা। এরপরও বিগত বছরের কথিত সাফল্যে পরিচালনা পর্ষদের কাছ থেকে ১০ ইনসেনটিভ হাতিয়ে নেন। পাশাপাশি নিজের বিলাসী জীবনের প্রয়োজনে কোটি টাকা মূল্যের ব্রান্ড নিউ গাড়ী ক্রয় করেন। আর এসব ক্ষেত্রে নিজেকেই বিলিয়ে দিয়েছেন মনোরঞ্জনে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) এই প্রতিবেদকের কাছে এমনটাই জানায় কয়েকজন বিনিয়োগকারী।
এ বিষয়ে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি সেলিম রেজা চৌধুরী জানান, মোহাম্মদী খানমের এমন চরিত্রহীন কাজকর্মে বিব্রত তার পরিবারও। তিনি বলেন, ‘মোহম্মদী খানমের স্বামী বেসরকারি ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রসঙ্গক্রমে একবার তিনি নিজেই আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তার এবং মোহাম্মদী খানমের সম্পর্কের কথা যেন প্রকাশ করা না হয়।’
অন্যদিকে খোন্দকার জিল্লুর রহমান নামে অপর এক বিনিয়োগকারী বলেন- শুধু এসবই নয়, ব্রাঞ্চ কনফারেন্সের নাম করে কোম্পানির চেয়ারম্যান জাকিউল্লাহ শহীদ, পরিচালক শাহ মোহাম্মদ হাসান, ডিএমডি সৈয়দ মনিরুল হক, অ্যাউন্টস বিভাগের প্রধান লালচাঁন মিয়াসহ কোম্পানির কতিপয় পরিচালক ও কর্মকর্তার সাথে বিভিন্ন সময়ে দেশের বাইরে আনন্দ-ফূর্তি করে সময় কাটিয়েছেন।
গত ৩০ মার্চ রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাধারণ সভায় বিব্রতকর এসব ঘটনা ধামাচাপা দিতে মোহাম্মদ মুনীরুজ্জামান নামে এক বিনিয়োগকারীর উপর চড়াও হয় কোম্পানির কয়েকজন অতি-উৎসাহী কর্মকর্তা। মুখ্য নির্বাহীর নির্দেশেই এমনটা ঘটে বলে জানান ঐ বিনিয়োগকারী। এ বিষয়ে রমনা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন উক্ত বিনিয়োগকারী।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ঐ দিন বেলা সাড়ে ১১টায় কোম্পানির চলমান বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেন ঐ বিনিয়োগকারী। বক্তব্য প্রদান শেষে নিচের হলরুমে আসা মাত্র পূর্ব পরিকল্পনামাফিক কোম্পানির সিইও মোহাম্মদী খানমের নির্দেশে কয়েকজন ভাঁড়াটে সন্ত্রাসী ঝাঁপিয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীর ওপর। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে উক্ত বিনিয়োগকারীর মোবাইল ও গলায় থাকা একটি সোনার চেনসহ নগদ ত্রিশ হাজার টাকা কেড়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাকিউল্লাহ শহীদ ও পরিচালক শাহ মোহাম্মদ হাসান ও মোহাম্মদী খানমের বিরুদ্ধে।
ইতিপূর্বে, কোম্পানি পরিচালনায় অনিয়ম এবং মুখ্য নির্বাহী মোহাম্মদী খানমের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আর এই সংবাদ প্রকাশের জেরে সাধারণ বীমা খাতের কোম্পানি প্রাইম ইন্স্যুরেন্স সিইওর রোষানলে পড়ে সেই সংবাদকর্মী। একইসাথে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি আপসরফা করতে সাধারণ ডায়েরি করা হয় থানায়। জিডির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুরোধে রমনা উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে বৈঠক বসেন সাংবাদিক নেতারা ও কোম্পানির কর্মকর্তারা। সেখানেই ‘ভুঁইফোড়’ সংবাদপত্র উল্লেখ করে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের প্রতি নিজের ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেন প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদী খানম। এ নিয়ে তখন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে পুলিশের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
সে সময়ে বৈঠকে উপস্থিত এক সাংবাদিক নেতা জানান, দেশের সাধারণ বীমাখাতের কোম্পানি প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের অভ্যন্তরীণ বহু অনিয়ম এবং কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী মোহাম্মদী খানমের দুর্নীতির তথ্য আসে গণমাধ্যমগুলোতে। এরপর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় তথ্যের সত্যতা মেলে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ অর্থবছরে কোম্পানির এফডিআর তহবিলে ৪০ কোটি টাকা থাকলেও বর্তমানে সেই তহবিলে মাত্র ১৪ কোটি টাকা রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ২৬ কোটি টাকা নগদায়ন করা হয়েছে। যার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই কোম্পানির তরফে। অন্যদিকে বর্তমান এমডি’র দায়িত্বকালে দেশের বিভিন্ন বিভাগে শাখা বন্ধ হয়ে যায়। এরপরও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কথিত ব্যবসায়িক সফলতায় গ্রহণ করেন ১০টি ইনসেনটিভ বোনাস। যা গত ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ২৮২তম পর্ষদ সভায় অনুমোদিত হয়। অথচ একটিও ইনসেনটিভ পায়নি কোম্পানির অনেক পুরোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী। ফলে এরূপ বৈষম্যমূলক নীতির কারণে কোম্পানি থেকে চলে যেতে বাধ্য হন ৫০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আবার কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করা কর্মকর্তাদের পাওনা দাবী দাওয়া মেটানো হয়নি এখন পর্যন্ত। অন্যদিকে কোম্পানির প্রতিষ্ঠালগ্নে বীমা সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাক এন্টারপ্রাইজ এর একটি বড় অংকের দাবী পরিশোধ করতে গড়িমসি করে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। পরে এ বিষয়ে ম্যাক এন্টারপ্রাইজ কর্তৃপক্ষ আদালতের শরণাপন্ন হলে তাদের দাবী পরিশোধ করতে বীমা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে একটি ডিক্রি দারী করে আদালত। এরপর বীমা সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানটিকে কিছু আর্থিক সহায়তা করলেও এখন পর্যন্ত পুরো দাবী পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটি। জানা যায়, কোম্পানির অনুকূলে দাবী পরিশোধের জন্য ফ্যাক (ঋঅঈ) রি-ইন্স্যুরেন্স কভার নেয়া হয়নি সাধারণ বীমা কর্পোরেশন থেকে। এ নিয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন প্রাইম ইন্স্যুরেন্সকে চিঠি দিলেও এখন পর্যন্ত কোম্পানির পক্ষ থেকে দাখিল করা হয়নি ফ্যাক স্লিপ। গুঞ্জন রয়েছে, বিষয়টি নিয়ে সাধারণ বীমার সাথে একটি আপোষ রফার চেষ্টা চালাচ্ছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। আবার কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন এবং শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটি দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি টাকার উপরে। এরপরও প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যায়ে সিইও’র জন্য ক্রয় করা হয় ব্র্যান্ড নিউ গাড়ী। ফলে প্রশ্ন ওঠে, কোম্পানির এমন হতাশজনক পারফরম্যান্সের পরও মোহাম্মদী খানমের বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা বীমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আইডিআরএ এর শরণাপন্ন হয়। কর্মকর্তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাদের দাবী দাওয়া মিটিয়ে দিতে আইডিআরএ নির্দেশ দিলেও সে বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি মোহাম্মদী খানমের নেতৃত্বে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। সে সময় এ নিয়ে মুখ্য কর্মকর্তার বক্তব্য জানতে চায় ওই সংবাদকর্মী। কিন্তু বারবার সময় চাওয়া হলেও তাতে ভ্রƒক্ষেপ করেনি উক্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। পরে তার বক্তব্য ছাড়াই সংবাদ প্রকাশ করতে চাইলে সেই সাংবাদিককে চাঁদাবাজ বলে অশালীন আচরণ করেন মোহাম্মদী খানম। এরপর তাকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তুমি যা পারো করো, আমি দেখে ছাড়বো তুমি কি করতে পারো’।
পরবর্তীতে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে পত্রিকাটির সম্পাদক এবং ইকোনোমিক মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুনীরুজ্জামানকে নাজেহালের পাঁয়তারা করতে থাকেন মোহাম্মদী খানম। প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে প্রতিবাদ ছাপানোর জন্য ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকার সম্পাদককে নির্দেশ প্রদান করেন। দেশের প্রথম শ্রেণীর একজন নাগরিকে একটি কোম্পানির সিইও নির্দেশ দিতে পারে কিনা এ নিয়ে হাসি-তামাশার সৃষ্টি হয়। অনেকে প্রশ্ন তোলেন ওই কর্মকর্তার মানসিক ভারসাম্যের স্থিরতা নিয়ে। অবশেষে উপায়ন্তুর না দেখে পুলিশের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দ্বারস্থ হন মোহাম্মদী খানম। সেই সাংবাদিককে ‘টাইট’ করার পাশাপাশি আপসের উদ্দেশ্যে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডির (নং-৫০৯, তাং- ১৭/১২/২০১৬) সূত্রে গত ০৩/০১/২০১৭ তারিখ নিজস্ব কার্যালয়ে আপস-মীমাংসা বৈঠক ডাকেন রমনা উপ-পুলিশ কমিশনার। বৈঠকে কোম্পানির পক্ষ থেকে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সকল প্রকার তথ্য সরবরাহ করা হবে এই মর্মে আপসরফা হয়। সিদ্ধান্ত হয় ওইদিনই তথ্য সরবরাহ করার। কিন্তু বৈঠক শেষে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা কোম্পানির কার্যালয়ে অপেক্ষা করলেও সাংবাদিকদের তা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হন কর্মকর্তারা। সে সময় ‘ভুঁইফোড়’ এবং ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পত্রিকা মন্তব্য করায় এ সম্পর্কে মোহাম্মদী খানমের কাছে জানতে চান এক সাংবাদিক। প্রশ্ন তোলা হয়, ভুঁইফোড় মন্তব্য করায় প্রশাসনকেও হেয় করা হয়েছে কিনা? কেননা প্রশাসনের অনুমোদন সাপেক্ষেই পত্রিকার প্রকাশনা কার্যক্রম চলে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আরেকদফা বাগবিত-ায় লিপ্ত হন সিইও মোহাম্মদী খানম ও কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা। ফলে ভেস্তে যায় আপসরফার বৈঠক। অদ্যাবধি সরবরাহ করা হয়নি এ সম্পর্কিত তথ্য। উপরন্তু গত ১০ জানুয়ারি কোম্পানির ভাড়াটে ৭-৮ জন দুষ্কৃতকারী হুমকি প্রদান করে পত্রিকাটির কার্যালয়ে কর্মরত অফিস স্টাফদের। সম্পাদককে হুমকি প্রদান করে প্রাণনাশের। যে কারণে আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় গণমাধ্যমটি। এ বিষয়ে পল্টন থানায় দায়ের করা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং- ৬৯৪, তাং-১০/০১/২০১৭)। অন্যদিকে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা ছাড়া এই ধরনের বৈঠকের আয়োজন করায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × two =