সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী খালি হাতে ফিরেছেন

0
1291
প্রতিরক্ষা সমঝোতায় বাংলাদেশের ওপর ভারতের সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়বে * ক্ষমতায় গেলে রিভিউ হবে স্বার্থবিরোধী চুক্তি * প্রধানমন্ত্রী তৃপ্ত হলেও জনগণ আতঙ্কিত * প্রধানমন্ত্রী ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন * তিস্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া উচিত সরকারের

গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন খালেদা জিয়া -যুগান্তর

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘নতজানুর কারণেই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) জাতীয় স্বার্থ আদায় করতে পারেননি। আশ্বাস নিয়ে তাকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে। এতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এই সফরকে দেশবাসী কেবলই দেয়ার এবং কোনো কিছুই না পাওয়ার এক চরম ব্যর্থ সফর বলেই মনে করে। সফর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তৃপ্ত হলেও জনগণ আতঙ্কিত।’ প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর ভারতের সামরিক, রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে ভারতের সামরিক পরিকল্পনার অংশ করে এসেছেন।

খালেদা জিয়া বলেন, দেশ-জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বার্থ জড়িত রয়েছে- এমন কোনো বিষয়ে বিএনপি নীরব থাকতে পারে না। ভারতের সঙ্গে করা চুক্তি ও সমঝোতার বিরুদ্ধে বিএনপি প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তা রিভিউ করার ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া।

বুধবার বিকালে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া তিস্তা চুক্তি না হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, তিস্তার পানি আমাদের অধিকার, কারও দয়া বা দাক্ষিণ্য নয়। এটা আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। কিন্তু সেই অধিকার আদায় বা সমস্যা সমাধানে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে দুই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করলে আরও ভালো হতো। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি। গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে ভারতের অনুমতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এখন এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে চুক্তি করলেই বিএনপির গায়ে লাগে- প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা ভারতবিরোধী নই। ভারত কেন, যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি করলে বিএনপি তার প্রতিবাদ জানাবে। কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক এবং ওলাম-মাশায়েখ সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে তিনি আবারও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার ওপর আস্থা রাখার যে আহ্বান জানিয়েছেন, সে প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, তার (প্রধানমন্ত্রী) ওপর আস্থা রেখে বাংলাদেশ কোনো কিছু অর্জন করতে পারেনি, পারবেও না। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ ছিল জানিয়ে খালেদা জিয়া আশা প্রকাশ করেন, আগামী নির্বাচনে তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও সংবাদ সম্মেলন নিয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করতেই এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে পূর্বনির্ধারিত বিকাল সাড়ে চারটার কয়েক মিনিট পরে লিখিত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন খালেদা জিয়া। লিখিত বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। এর আগে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও বুধবার খালেদা জিয়া একাধিক প্রশ্নের জবাব দেন।

এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল আউয়াল মিন্টু, সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান, মোহাম্মদ শাহজাহান, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান প্রমুখ।

২০ দলীয় জোট নেতাদের মধ্যে বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান টিআইএম ফজলে রাব্বি চৌধুরী, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেন, দেশে জনসমর্থিত ও গণতান্ত্রিক কোনো সরকার না থাকলে তাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে কোনো রাষ্ট্রের কাছ থেকে জাতীয় স্বার্থ আদায় করে আনা সম্ভব নয়। সে কারণেই বর্তমান প্রশ্নবিদ্ধ সরকার যতই বন্ধুত্বের বুলি আওড়াক না কেন, প্রতিবেশী ভারতের কাছ থেকেও সমমর্যাদার ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থ আদায় করতে তারা পারেনি, পারবেও না।

ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রীকে আপ্যায়নের বিষয়টি উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আপ্যায়নের চেয়ে তাদের ন্যায্য পাওনা কী এসেছে সেটা জানতে চায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, জমকালো আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে বাংলাদেশ যে বঞ্চিত ছিল, সেই বঞ্চিতই থেকে গেল। বাংলাদেশ আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল। দু’দেশের যৌথ ইশতেহারে যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশে এখন সেই গণতন্ত্র নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

ভারত সফর শেষে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, দেশবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি দিল্লিতে কিছু চাইতে যাননি। কেবল বন্ধুত্বের জন্য গিয়েছিলেন এবং সেটা তিনি পেয়েছেন। কিসের এই বায়বীয় বন্ধুত্ব তা দেশবাসীই বিচার করে দেখবেন। তবে এই কথার মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন যে, ভারত থেকে তিনি দেশের জন্য কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি। বরং ভারতের চাহিদা মোতাবেক সবকিছুই দিয়ে এসেছেন।

সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, চুক্তি ও সমঝোতাগুলো প্রকাশ করার বদলে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) তার নিজের ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার ওপর আস্থা রেখে দেশবাসী আজ পর্যন্ত কোনো কিছুই অর্জন করতে পারেনি। বরং ভোট দেয়ার অধিকারসহ বিভিন্ন অধিকার হারিয়েছে। তার ওপর আস্থা রেখে অতীতে জনগণ দেখেছে, তিনি একের পর এক জাতীয় স্বার্থবিরোধী অসংখ্য চুক্তি করেছেন। ভারতকে একতরফাভাবে কেবল দিয়েই এসেছেন। বিনিময়ে কিছুই আনতে পারেননি। ভারতের সঙ্গে করা সমঝোতা ও চুক্তির বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসবের ফলে বাংলাদেশের ওপর ভারতের সামরিক, রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যই কেবল বাড়বে।

তিস্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া উচিত : তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ভাটির দেশ হিসেবে সব আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া আমাদের অধিকার। এটা কারও কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার বিষয় নয়। তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি দুই সার্বভৌম দেশের মধ্যকার বিষয়। এ জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকেই বিষয়টি ফয়সালা করতে হবে। তৃতীয়পক্ষ হিসেবে ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে দুই দেশের মধ্যকার আলোচনায় সংশ্লিষ্ট করায় বাংলাদেশের সার্বভৌম মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকারের আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।

প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক : প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবার মতামতকে উপেক্ষা করে এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে আমরাও শঙ্কিত। তিনি বলেন, নানা বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তা সত্ত্বেও জাতীয় স্বার্থ, মর্যাদা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার বিষয়ে আমরা সবাই মিলে একটি অভিন্ন অবস্থান গ্রহণের পক্ষে। ভারত সফরকালে শেখ হাসিনা এসব বিষয় সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে দৃঢ় ভূমিকা পালন করলে আমরা অকুণ্ঠচিত্তে তার সেই ভূমিকার প্রতি সমর্থন জানাতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি তা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। বরং তিনি বাংলাদেশকে ভারতের সামরিক পরিকল্পনার অংশ করে এসেছেন।

প্রতিরক্ষায় ৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রসঙ্গে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা যাই বলুন না কেন, ভারতই হবে ওই ঋণের আওতায় একমাত্র অস্ত্র সরবরাহকারী। এ সফরে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যেভাবে ভারতের সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে, তার ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস, কারিকুলাম ও অন্যান্য স্পর্শকাতর বিষয়াদি অযাচিত হস্তক্ষেপের মুখে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

সশস্ত্র বাহিনী এখন বিভিন্ন দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক উচ্চমান অর্জন করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কোনো অস্ত্র আমদানিকারক দেশ থেকে এই বাহিনীর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করলে সেই মানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চীনের অস্ত্র ব্যবহারে আমরা অভ্যস্ত। আমরা যখন অস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তি বা সমঝোতা করেছি, তখন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে চুক্তি ও সমঝোতা করেছি। আমরা পুরনো জিনিস ক্রয় করিনি। চীন শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের অনেক দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে। তিনি বলেন, বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তারা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে বাকশালে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। তিনি বলেন, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো দেশের সম্পৃক্ততার ফলে বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জিত মান ও স্বাতন্ত্র্য সমঝোতার নামে ব্যাহত হতে পারে বলেও সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আলোচনায়ই আসেনি : বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, কারও সঙ্গে পরামর্শ বা জনগণকে অন্ধকারে রেখে গোপনীয়ভাবে চুক্তি করায় সবার মধ্যে যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছিল সফরের পর তা যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা, গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প, সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং বাংলাদেশি রফতানি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করার মতো বাংলাদেশের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোর এ সফরে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। জনগণের দাবি সত্ত্বেও আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের সুন্দরবন-বিনাশী এবং পরিবেশবিধ্বংসী রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের স্থান পরিবর্তনের জন্য তিনি একটি কথাও বলেননি। বরং প্রধানমন্ত্রীকে কতগুলো আশ্বাস নিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে আরও লক্ষ্য করেছি, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করার জন্য যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো দূর করা প্রয়োজন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি।

বিগত নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ : ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোট নেতা খালেদা জিয়া বলেন, ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে খুবই ন্যক্কারজনকভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। ভারতের তখনকার বিদেশ সচিব বাংলাদেশ সফরে এসে ক্ষমতাসীনদের প্রহসনের নির্বাচনের নীলনকশা বাস্তবায়নে প্রকাশ্যে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা কারও অজানা নয়। সে কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ভারতের বিগত সরকারই আওয়ামী বলয়ের শাসন ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার ক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা করেছে এবং তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থনেই এ দেশের জনবিচ্ছিন্ন সরকার ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। এ দেশের জনগণ আরও মনে করেন যে, বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সমঝোতার ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারেনি বা করেনি। তারা শুধু কৃতজ্ঞতার ঋণই ক্রমাগত শোধ করে চলেছে। এতে বিসর্জন দেয়া হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা। খর্ব হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব। শেখ হাসিনা বলেছেন, এ সফরে তিনি তৃপ্ত। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এ সফরের ফলাফলে তৃপ্ত তো নয়ই বরং আতঙ্কিত। তারা জাতীয় স্বার্থবিরোধী একগাদা চুক্তি ও সমঝোতা চায়নি। হিসাবের পাওনা চেয়েছে।

ভারতের সঙ্গে বিএনপির কোনো বৈরিতা নেই মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতার কথা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে অর্থনীতি, বাণিজ্য, পানিসম্পদ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাবলী নিরসনের নীতিতে আমরা বিশ্বাসী। ভারতের জনগণের সঙ্গে শান্তি ও সহযোগিতার আবহে আমরা পাশাপাশি বাস করতে চাই। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ব্যাহত করতে ভারতের বিগত শাসকদের একতরফা ভূমিকায় বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। আমরা আশা করি, ভারতের বর্তমান সরকার অতীতের সেই ভুল থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের মনোভাবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন।

প্রধানমন্ত্রী ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন : প্রধানমন্ত্রী ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, দেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতিকে এক্সপ্লয়েট করার জন্য শেখ হাসিনা ভারত সফরের আগে আলেম সম্মেলন করেন। ফিরে এসে আবার হেফাজতে ইসলাম প্রভাবিত কওমি মাদ্রাসার ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আলেমদের সঙ্গে তার অতীত আচরণ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ক্রমাগত আঘাতের কথা দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। এখন তিনি নিজেই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। অতীতেও তাই করেছেন।

বিদেশীরা বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে চক্রান্ত করেছিল প্রধানমন্ত্রীর এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য দাবি করে তিনি বলেন, বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে কিন্তু কোনো প্রভু নেই। বিদেশি চক্রান্তে নয়, জনগণের ভোটেই বিএনপি সব সময় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। বরং আওয়ামী লীগই ভোট ছাড়া বিদেশী মদদ নিয়ে ক্ষমতায় আসার খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

এক প্রশ্নের পাল্টা সাংবাদিকদের কাছে তিনি জানতে চান, দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তিসহ কিভাবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়া হচ্ছে তা তো আপনারা ভালো জানেন।

বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলে একসঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। ওই লড়াইয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে গুলির ঘটনায় আমি প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছিলাম। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছি, ভবিষ্যতেও করব।

দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিমকোর্টের সামনে গ্রিক মূর্তির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের কারও সঙ্গে কথা হয়নি। কেউ এসে আমাদের এই মূর্তি নিয়ে কথা বলেনি। এটা আমার ব্যাপার নয়, এটা সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে। তাদের পবিত্রতার ব্যাপার। সেখানে প্রধান বিচারপতিই সবকিছু। কাজেই এটা নিয়ে কী করবেন, না করবেন সেটা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব।

কাল দিল্লিকা লাড্ডু খেয়েছেন আজ বাংলাদেশেরটা খেয়ে যান : সংবাদ সম্মেলনের শেষে সবাই উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘গতকাল প্রধানমন্ত্রী তো আপনাদের দিল্লিকা লাড্ডু খাইয়েছেন, আজ আমি আপনাদের বাংলাদেশের লাড্ডু খাওয়াচ্ছি। খেয়ে যাবেন সবাই।’ তার এমন মন্তব্যে সবাই হেসে দেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seven − 4 =