চিকেন পক্স বা জলবসন্ত ভাইরাসজনিত একটি সংক্রামক রোগ। ভ্যারিসেলা জস্টার নামের একটি ভাইরাসের কারণে জলবসন্ত হয়। যেকোনো বয়সেই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও শিশু ও অল্পবয়সীরা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে।
রোগের উপসর্গ ঃ
* প্রধান উপসর্গ হলো জ্বর এবং শরীরে ফুসকুড়ি ওঠা। শরীর ম্যাজম্যাজ করে, ব্যথা হয়।
* র্যাশ বা ফুসকুড়ি প্রথম দিনেই উঠতে পারে। পিঠে ও বুকে এগুলো প্রথম দেখা যায়, পরে মুখে ও মাথায় ওঠে।
* পায়ের তলা ও হাতের তালুতে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
* সাধারণত প্রথম দিনে ফুসকুড়ি-গুলোর মধ্যে পানি জমা হতে থাকে- দেখতে ফোস্কার মতো হয়। কোনো কোনো ফুসকুড়ি তরল পদার্থপূর্ণ, কোনো কোনোটি পুঁজে পূর্ণ হয়।
* তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ফুসকুড়ি পুরোপুরি বিস্তার লাভ করে এবং সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
* শরীর চুলকাতে থাকে।
* এরপর ধীরে ধীরে ফুসকুড়ি শুকাতে শুরু করে এবং শুকানোর পর আস্তরণগুলো ঝরে যেতে থাকে। সাধারণত দু’সপ্তাহের মধ্যে শরীরের সব আস্তরণ ঝরে যায়।
কীভাবে এ রোগ ছড়ায় ?
* চিকেনপক্সে আক্রান্ত রোগীর হাঁচি ও কাশি থাকে।
* আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে।
* আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত জিনিস স্পর্শ করলে। আক্রান্ত রোগীর নিঃশ্বাসের বাতাস থেকে।
* আক্রান্ত রোগীর কাছাকাছি অবস্থান করলে সেখানকার বাতাসের মাধ্যমে।
* আক্রান্ত রোগীর শরীরে ফুসকুড়ি ওঠার পাঁচ দিন আগে থেকে এবং ফুসকুড়ি শুকিয়ে যাওয়ার ছয় দিনের মধ্যে কেউ সংস্পর্শে এলে। মনে রাখতে হবে ভেরিসেলা ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথে উপসর্গ দেখা দেয় না। সাধারণত ১৪-২১ দিন (মোটামুটিভাবে ১৭ দিন) পর্যন্ত রোগটি শরীরে সুপ্তাবস্থায় থাকে। পরে ধীরে ধীরে উপসর্গ
দেখা দেয়।
রোগের চিকিৎসা ঃ
চিকেনপক্সের রোগী সাধারণত এমনিতে ভালো হয়ে যায়। তবুও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। রোগীর কষ্ট লাঘব করার জন্য এবং পরবর্তী সময়ে যাতে ইনফেকশন না হয়, সে জন্য কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
* রোগীকে প্রথমত আলাদা ঘরে রাখতে হবে। রোগীর ত্বক পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রতিদিন বিছানার চাদও বদলাতে হবে।
* চুলকানির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ খেতে হবে।
* জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে।
* ইনফেকশন রোধ করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পাঁচ-সাত দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে।
* ত্বকে ইনফেকশন হলে মুখে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি ত্বকে ক্লোরহেক্সিডিন অ্যান্টিসেপটিক মলম লাগানো যেতে পারে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন ?
প্রাথমিক পর্যায়ে ঃ
* তীব্র এবং ঘনঘন কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে এবং এমনিতেই সেরে যায়।
* লসিকা গ্রন্থিব্যথা, লাল এবং লসিকা নালী ফুলে যায়। কুচকির কাছের লসিকা গ্রন্থির নালী বেশি আক্রান্ত হয়।
* অন্ডকোষ ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়।
* মারাত্মক পর্যায়ে শরীরের যে সকল জায়গা আক্রান্ত হয় সে সকল স্থান ফুলে যায় এবং মোটা হতে থাকে। আক্রান্ত জায়গা গুলো শক্ত হয়ে যায়, চাপ দিলে বসে যায়না। হাঁটুর নিচের অংশে বেশি দেখা যায়।
* লসিকাগ্রন্থি ফেটে যাওয়ার কারণে দুধের মতো সাদা লসিকা রস প্রসাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়।
* অন্ডকোষের মধ্যে পানি জমে যায়।
* অন্ডকোষে প্রদাহ হয়।
জটিলতা ঃ
* নিউমোনিয়া
* মস্তিষ্কের প্রদাহ
* রক্তক্ষরণ
* ত্বকের ইনফেকশন
* হৃদপিন্ডের মাংসপেশির প্রদাহ
* কিডনির প্রদাহজনিত রোগ
* রক্তের ইনফেকশন
* গর্ভস্থ শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্মগত ত্রুটি।
প্রতিরোধ ঃ
প্রতিরোধের জন্য টিকা নিতে পারেন। শিশুদের জন্য ১২ থেকে ১৫ মাস বয়সে প্রথম ডোজ ও চার থেকে ছয় বছর বয়সে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। ১৩ বছরের বেশি বয়সীরা চার থেকে আট সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি ডোজ নিতে পারেন। তবে গর্ভবতী মায়েদের ও খুব রোগাক্রান্তদের এ টিকা নেওয়া যাবে না।
রোগীকে কী খাওয়াবেন ?
এ সময়ে রোগীকে অনেক পুষ্টিকর খাবার দেওয়া প্রয়োজন হয়। তবে খাবারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজি সবকিছুই খাওয়া যাবে। আর শরীরের দুর্বলতা দ্রত কাটিয়ে উঠতে রোগীকে বেশি বেশি করে খেতে হবে।
কীভাবে গোসল করাবেন ?
জলবসন্ত হওয়ার পরও নিয়মিত গোসল করা যায়। এতে কোনো সমস্যা হয় না। তবে গোসল শেষে শরীর ঘষে মোছা যাবে না, আলতো করে মুছে নিতে হবে। স্বাভাবিক পানি দিয়ে গোসল করানো যাবে। আর রোগীর ব্যবহৃত পোশাক, বিছানার চাদর, শোবার ঘর অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেহেতু এ রোগে শরীরে দাগ হয়, তাই এ সময়ে ডাবের পানি খুব উপকারী এবং ডাবের পানি দিয়ে মুখ ধোয়া এবং গোসল করলেও উপকার পাওয়া যাবে।
ডাঃ মোহাম্মদ আবু তাহের মিয়া
ই.এম.ও
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল)
এবং
পরিচালক (অনারারী)
সাভার সেন্ট্রাল হাসপাতাল