বেওয়ারিশ লাশের মিছিল থামাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে!!!! বেওয়ারিশ লাশের মিছিল থামাতে হবে !!

0
1547

আশিকুর রহমান হান্নান ঃ
বাংলাদেশে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশের মিছিল। সনাক্ত করতে না পারার কারণে বেওয়ারিশ হিসেবেই দাফন হচ্ছে এসব লাশ। আর খুনীরা জঘন্য অপরাধ করেও থেকে যাচ্ছে ধরা ছোয়ার বাইরে। রাজধানীর আশপাশের অন্তত ৭টি উপজেলা অজ্ঞাত লাশ ফেলার নিরাপদ জোনে পরিণত হয়েছে। এসব স্থান থেকে একের পর এক অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, ব্যবসায়ীক বিরোধসহ বিভিন্ন দ্বন্দ্বের জের ধরে অপহরণের পর খুন করা হচ্ছে মানুষকে। এসব মানুষকে হত্যার পর ঘাতকরা লাশ ফেলার জন্য বেছে নিচ্ছে নির্জন স্থান। আর এসব স্থান থেকে পচাগলা অবস্থায় লাশগুলো উদ্ধারের ফলে পরিচয় সনাক্ত করাও সম্ভব হচ্ছে না। পরিচয় না পাওয়ায় লাশগুলো হয়ে যাচ্ছে বেওয়ারিশ। পুলিশ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ঘোষণা করে তাদের দাফন করছে। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই প্রতি বছর গড়ে দেড় হাজারের মতো বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যায়। আর সেসব লাশে আঘাতের ধরন এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট মিলিয়ে শতকরা ৮০ ভাগই হত্যাকান্ড বলে প্রতীয়মান হয়। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এসব হত্যাকান্ড কি কারণে ঘটছে ওই  বিষয়টি অজানাই থেকে যাচ্ছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর মতে, লাশ শনাক্তে পুলিশের যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। একস্থানে হত্যার পর অন্যস্থানে লাশ ফেলে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা নিজেরা দায় থেকে বাঁচতেই হয়তো বিকৃত করে এক এলাকার লাশ অন্য এলাকায় নিয়ে ফেলে। আবার কখনও লাশ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে। এসব লাশের অধিকাংশের শেষ পর্যন্ত পরিচয় জানা যায় না। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া লাশের মধ্যে বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। রাজধানী এবং এর উপকণ্ঠ থেকেই উদ্ধার করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি বেওয়ারিশ লাশ। এর মধ্যে রূপগঞ্জের পূর্বাচল উপশহর, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদী, ডেমরা, মিরপুর বেড়িবাঁধ, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর রেললাইনের দু’পাশ, শ্যামপুরের ওয়াসা পুকুরপাড়, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ, কাঞ্চন-কুড়িল ৩০০ ফুট সড়ক, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট ও কেরানীগঞ্জ থেকে প্রতি মাসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার হয়েছে। লাশের হত্যার পর কারও শরীর থেকে হাত-পা ও কারও মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার কারও চোখ উপড়ে এবং মুখ বিকৃত করে লাশ বস্তাবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৫ টায় রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল উপশহরের ১৩নং সেক্টরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো কালো রংয়ের একটি ভারী ব্রিফকেস। সেটিকে ঘিরে একদিকে কৌতুহল অন্যদিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। লোকজন বিষয়টি অবহিত করেন রূপগঞ্জ থানায়। পুলিশ এসে সেটি খোলেন। এর পরই হতচকিয়ে ওঠেন। দেখতে পান এক তরুনীর নিথর দেহ। যার হাত-পা বাঁধা। দেখা যায় এ তরুনীর দেহে প্রাণ নেই। ততক্ষণে সেটির পরিচয় হয় তরুনীর লাশ। আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী এ তরুনীর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করে তা ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে। অজ্ঞাত এ তরুনীর পরিচয় উদঘাটনে পুলিশ মাঠে নামে। কিন্তু ব্যর্থ তারা। লাশটি বেশ কিছু দিন পড়ে থাকে মর্গে। পরিচয় না মেলায় শেষ পর্যন্ত বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে। যে সংস্থাটি বেওয়ারিশ লাশের দাফনসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। হতভাগা ওই তরুনীকে শ্বাসরোধ্য করে হত্যা করেছে খুনিরা। অন্য কোথাও তাকে হত্যা করার পর একটি কালো রংয়ের ব্রিফকেসে ভর্তি করে পূর্বাচল উপশহরের ১৩নং সেক্টরে ফেলে যায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। কিন্তু নিহতের পরিচয় কিংবা খুনিদের সম্পর্কে জানা যায়নি। এদিকে, চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল বেলা ৩টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণখালী এলাকায় পূর্বাচল উপশহরের সীমানার পাশে খালের মধ্যে বালুর নিচ থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বালুর নিচে চাপা দেওয়া অবস্থায় পচা-গলিত লাশ দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়। ওই যুবককে অন্তত ৫/৬ দিন আগে কে বা কারা গলায় গেঞ্জি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে খালের মধ্যে বালুর নিচে চাপা দিয়ে রেখে গেছে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। লাশটির কোন দাবিদার না পেয়ে শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এভাবেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশ মিলছে খালে, বিলে, নদী, মহাসড়কের পাশে, পূর্বাচল উপশহরের নির্জন স্থানে এমনকি ডাস্টবিনেও। আবার ডোবা-নালা ও ময়লার স্তুপেও মিলছে অজ্ঞাত লাশ কিংবা পচে-গলে যাওয়া মানুষের কঙ্কাল। ময়নাতদন্তের পর বেওয়ারিশ হিসেবে এসব লাশ দাফন করছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। লাশ উদ্ধারের পর যথারীতি থানায় মামলা হয়। তবে মামলা করেই ক্ষান্ত পুলিশ। এরপর আর তদন্ত এগোয় না। পরিচয় শনাক্ত হয় না এসব বেওয়ারিশ লাশের। হত্যাকারীও গ্রেফতার হয় না। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে অপরাধীরা। এসব ঘটনায় থানায় মামলার পর পুলিশ মামলার তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অদূর ভবিষ্যতে নিহত ব্যক্তির পরিচয় বা হত্যার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করা হলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে। কিন্তু মামলা পুনরুজ্জীবিত কিংবা কোন ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয় না। মেলে না বেওয়ারিশ লাশের পরিচয়। এদিকে, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান অনেকে। এসব ঘটনায় নিহতদের অনেকেরই পরিচয় মেলে না। আবার পূর্ব শত্রুতা কিংবা অপহরণের পরেও অনেককে হত্যার পর লাশ ফেলে দেয়া হয় যেখানে সেখানে। অনেক ক্ষেত্রে পরিচয় উদঘাটন যাতে না হয় সেজন্য লাশের চেহারা বিকৃত করে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এসব লাশই এক সময় পরিচিতি পায় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, বিভিন্ন স্থান থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় মানুষের শরীরের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশ উদ্ধার করা হয়। তাদেরকে হত্যা করার স্পষ্ট নমুনা মেলে। এটি অসুস্থ সমাজেরই নির্দেশনা। প্রত্যেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা নিজের ঠিকানা লিখে তা সঙ্গে রাখা উচিত। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, বেওয়ারিশ লাশের পরিচয় শনাক্তের ক্ষেত্রে পুলিশ যথাযথ উদ্যোগ নেয়। আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। কোন অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ নিহত ব্যক্তির ছবি টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করে। তারপরও দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে লাশ বিকৃত থাকায় অনেক সময় পরিচয় শনাক্ত দুষ্কর হয়ে যায়। এই লাশ গুলোর পরিচয় জানার সম্ভাবনা অনেক কম। তবে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ সফল হয়েছে। বেওয়ারিশ প্রতিটি লাশের ছবি সংরক্ষণ করে গোয়েন্দা পুলিশ। তবে বেওয়ারিশ লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট মিলিয়ে দেখা যায় এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই হত্যাকান্ডের শিকার। অধিকাংশ লাশের গায়ে বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। কিন্তু বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করার পর হত্যার কারণ বা হত্যাকান্ড নিয়ে দু’একদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটু সোচ্চার থাকলেও এক সময় সব প্রক্রিয়া থেমে যায়। এভাবে চলতে থাকে মাসের পর মাস। মেলে না লাশের পরিচয় বা ওয়ারিশ। নিকটাত্মীয়রা জানতেও পারে না তার প্রিয়জনের কবরটি সারি সারি কবরের মধ্যে পড়ে আছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে অপরাধীরা। এসব মানুষের কিছু অংশ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও বেশিরভাগ হয়েছে খুনের শিকার। গুম, গুপ্তহত্যা কিংবা প্রতিহিংসার শিকার এসব লাশের আর পরিচয় শনাক্ত হয় না। ওয়ারিশ নিয়ে জন্মালেও বেওয়ারিশ হিসেবে এদের ঠাঁই হয় কোন কবরস্থানে। পুলিশ সূত্র জানায়, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদী, মেঘনা নদী, পদ্মা নদী, বুড়িগঙ্গা নদী, ধলেশ্বরী নদী, তুরাগ নদীসহ বিভিন্ন ডোবা-নালা, মহাসড়ক সড়কের পাশ থেকে বেশিরভাগ অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশগুলোর কোনটি থাকে গুলিবিদ্ধ, কোনটি হাত-পা বাঁধা, কোনটি মস্তকবিহীন আবার কোনটির থাকে জখমের চিহ্ন। সংঘবদ্ধ অপরাধীরা হত্যার পর গুমের কৌশল হিসেবে লাশ এসব স্থানে ফেলে পালিয়ে যায়। অনেক লাশই পচে গলে বিকৃত হয়ে যায়। ফলে পরিচয় শনাক্ত করা যায় না। তবে হত্যাকান্ডের পাশাপাশি দুর্ঘটনার পরও বেশকিছু লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়।
পৃথিবীতে কেউ তো বেওয়ারিশ হয়ে জন্মায় না, তাহলে মানুষকে মৃত্যুর পর বেওয়ারিশ হতে হবে কেন? মা-বাবার হাত ধরে সন্তানের ধরণীতে আগমন ঘটে। এখানে এসে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানুষ যেমন কারো তত্ত্বাবধানে থাকে তেমনি পরিণত বয়সে তার ওয়ারিশ হিসেবে কাউকে না কাউকে ধরায় আনে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চক্রাকারে মানুষের বংশগতি রক্ষা হয়েছে। ধরণী থেকে কারো বিদায়ের মাধ্যমেই তার সম্পূর্ণ পরিচয় মুছে যায় না বরং মানুষের কর্ম এবং সৃষ্টির মাধ্যমে হাজার হাজার বছর মৃত মানুষও জীবিত মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকে। যারা পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণ সাধন করে খ্যাত হয়েছেন তাদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ জীবিত মানুষেরা এ সকল মানুষের মৃত্যুর হাজার বছর পরেও তাদের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করে কিংবা বিভিন্ন সভা সেমিনারে তাদের নাম সম্মানের সাথে উচ্চারণ করা হয়। শুধু যে ইতিবাচকভাবে স্মরণ করতে হবে এরকম কোন কথা নেই বরং যুগে যুগে বিশ্বের কিছু ঘৃণিত মানুষের নামও উচ্চারণ করা হচ্ছে। এ সকল ব্যক্তিরা তাদের জীবদ্দশায় মানবকল্যাণে কোন কাজ করেনি কিংবা বিশ্ববাসীর জন্য এমন কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছে যা গোটা বিশ্ব কিংবা রাষ্ট্রকে ক্ষতির কিংবা হুমকির সম্মুখীন করেছে। তবুও তাদেরকে স্মরণ করা হয় কারণ ইতিহাস বলে একটা অধ্যায় আছে। আর ইতিহাস থেকেই মানুষ অতীতের সাথে পরিচিত হয় কিংবা শিক্ষা গ্রহণ করে। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যিনি কোন না কোন দিকের বিবেচনায় মূল্যহীন। হতে পারে পৃথিবীতে কারো প্রয়োজন অনেক আবার কারও অতি সামান্য। তবুও সবাই অতি নগন্য হলেও মূল্যবান। আবার এমনও ব্যক্তি আছে যিনি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বহীন কিন্তু তার নিজস্ব পরিমন্ডল অর্থ্যাৎ তার পরিবার কিংবা বিশেষ কারো কাছে সবকিছু। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা জীবিত থাকার সময় যতটুকু প্রকাশ না পায় সে মৃত্যু বরণ করলে তার সবটাই প্রকাশ পায়। সাধারণত মাত্র কয়েক বছরের জন্য মানুষ এক দেশ থেকে অন্যদেশে পাড়ি জমালে তাতেই আত্মীয় স্বজনের কষ্টের সীমা থাকে না। কাজেই যদি চিরতরে কেউ পৃথিবীর সকল মায়া ছিন্ন করে চলে যায় কিংবা যেতে বাধ্য করা হয় তারপরেও তার প্রতি মায়া থেকেই যায়। মৃত্যুর পরে কখনো কখনো মায়ার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। মানুষের মৃত্যুবরণে তার শূন্যতা এবং প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি অনুধাবন করা যায় যতটা তার জীবদ্দশায় অনুধাবিত হয়নি। এভাবেই এ জগত সংসার চলছে। কারো পিতামাতা, সন্তান কিংবা অন্যকোন আত্মীয় স্বজন মৃত্যুবরণ করলে তার স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে মালিকানাধীন কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে সমাহিত করে তাকে হৃদয়পটে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। আত্মীয় স্বজনের লাশ সবার কাছেই বোঝা কারণ আপন জনের প্রস্থান অন্তরের গভীরে আঘাত করে কিন্তু এতটা বোঝা নয়, যে বোঝার ভার বহন করতে মানুষ অস্বীকার করবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশ্বায়ণের পূর্ণ প্রভাব ছোঁয়া দিলেও বাংলাদেশে এখনও ততোটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। যে কারণে বাংলাদেশের মানুষ সবাইকে আপন ভাবতে পারে এবং একজনের ব্যথায় অন্যজন এখনও ব্যথিত হয়। আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণেই এ অঞ্চলের মানুষ অনেকটা আবেগপ্রবন যে কারণে সবাই সবাইকে আপন ভাবে, ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। তবে মানুষের ভালো তো আর চিরকাল থাকে না। একটি স্থির ও শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থায় স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের প্রভাব ইতোমধ্যেই আঁচ ফেলেছে। যে কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবক্ষয় প্রকট আকার ধারণ করেছে। যে কারণে প্রত্যহ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেওয়ারিশ অসংখ্য লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এ সকল লাশের কোন পরিচয় পাওয়া না যাওয়ার কারণে এর পিছনে কারা দায়ী তা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তবে প্রশাসন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারনা মতে, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অবৈধ সম্পর্ক, ভয়াবহ দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণে দিনে দিনে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিশেষ করে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মতে, তারা যে সকল বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে তার অধিকাংশ রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার। অতীতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক বেওয়ারিশ লাশের যে হিসাব প্রদান করা হয়েছে তা স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষকে অবশ্যই চিন্তিত করে তুলবে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মতে, প্রতিবছর শুধু রাজধানীতেই গড়ে দেড় হাজার বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যায়। এ সংস্থাটিকে প্রতিদিন গড়ে ৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করতে হয় অর্থ্যাৎ মাসে প্রায় ১২৫টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করতে হয়। দেশের সর্বত্র মিলছে লাশ। প্রতিনিয়ত খাল, বিল, নদী, রেললাইনের কাছে, জঙ্গলে পাওয়া যাচ্ছে অসংখ্য মৃতদেহ। আবাসিক ভবন, সড়ক-মহাসড়ক, ড্রেন, গর্তসহ কোথাও যেন লাশের কমতি নাই। শুধু এ সকল লাশের নাম-পরিচয় মিলছে না। যে সকল লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তার অধিকাংশই হত্যাকান্ডের শিকার। এ হত্যাকান্ড হতে পারে রাজনৈতিক কিংবা অন্যকোন প্রকারের। কিছু সংখ্যক মৃত্যুবরন করছে ট্রেনে কাটা পড়ে অথবা সড়ক দুর্ঘটনায়। অন্যদিকে লক্ষণীয়, হত্যার পর মৃত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন অংশ খন্ড-বিখন্ড করে ফেলায় কিংবা এসিড়ে ঝলসে দেয়ায় বেশির ভাগ লাশেরই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। বেওয়ারিশ লাশ তৈরিতে কারা দায়ী?
মানুষ মারা যেতে পারে এবং সেটা স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভিবিক উভয়ই হতে পারে কিন্তু তার পরিচয় থাকবে না কেন? কেন বেওয়ারিশ হবে? বলা বাহুল্য, শনাক্তকৃত লাশের সংখ্যা এই বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যার সাথে যোগ করলে লাশের অংকটি কত বিশাল হবে, তা ভাবা যায়! কেন এ হত্যাকান্ড? কোন উদ্দেশ্যে দেশে এগুলো ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে? এই সমাজ কি তাহলে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে? দেশে এত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থাকা সত্ত্বেও এত লাশ কেন এ জাতি উপহার পাচ্ছে! ওয়ারিশ কিংবা বেওয়ারিশ লাশের দীর্ঘ মিছিল কমিয়ে আনতে সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আরও বেশি তৎপর হতে হবে র‌্যাব-পুলিশসহ সব গোয়েন্দা সংস্থাকে। ঘাতকদেরকে দ্রুত সনাক্ত করে তাদেরকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। তা না হলে বেওয়ারিশ লাশের সাথে চিহ্নিত লাশের সারিও দিনে দিনে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতেই থাকবে। বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পুলিশকে আরও তৎপর এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নির্ভর হতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × four =