ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির প্রতারণা ৩০০ কোটি টাকার কোনো হদিস নেই

0
1545

সমবায় অধিদফতরের উদাসীনতায় টাকা পাচ্ছে না গ্রাহক * ৬ পরিচালকের একজন জেলে, পাঁচজনই লাপাত্তা

ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির হাতিয়ে নেয়া গ্রাহকের আমানতের ৩০৩ কোটি টাকার খোঁজ মিলছে না। অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার সহজ সরল গ্রাহকের কাছ থেকে এই বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে সমিতির ছয় পরিচালকের পাঁচজনই লাপাত্তা চার বছর ধরে। সমিতির বিনিয়োগকারীরা এখন আসল টাকা ফিরে পেতে চাইলেও সমবায় অধিদফতরের কার্যকর উদ্যোগের অভাবে সেটাও হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমিতির গ্রাহকের অর্থের একটি মোটা অংশ সমিতির পরিচালকদের মালিকানাধীন ম্যাক্সিম গ্রুপে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাকি টাকায় বিলাসী জীবনযাপন ছাড়াও বিদেশে পাচারের অভিযোগও রয়েছে। সমিতির কার্যক্রম শুরুর পর তুলনামূলক অল্প সময়েই ২৩ হাজারের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে তিনশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এর মধ্যে আইনবহির্ভূতভাবে অর্থ নেয়া হয় ১৮ হাজার গ্রহকের কাছ থেকে। অতি মুনাফার লোভ দিয়ে কারও কাছ থেকে ১৬ লাখ, ১০ লাখ, ১২ লাখ করে টাকা নেয়া হয়। কিছুদিন লভ্যাংশ দিয়ে বিপুল অংকের অর্থের মজুদ গড়ে তোলার পর শুরু হয় বিপত্তি। পরে গ্রাহকরা আন্দোলনে নামলে হস্তক্ষেপ করে সমবায় অধিদফতর। ২০১৩ সালের মার্চে অধিদফতর আগের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন অ্যাডহক কমিটি গঠন করে। শুরু হয় তদন্ত, এরপর থেকেই সমিতির অপকর্ম বের হতে শুরু করে।
সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে সমবায় অধিদফতরের যুগ্ম-নিবন্ধক মো. রুহুল আমিন বলেন, ম্যাক্সিম সমিতি গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩০৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এ টাকা ম্যাক্সিম কোথায় বিনিয়োগ করেছে, কোন সদস্যের টাকার পরিমাণ কত সেসব হিসাব করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু সদস্যের পাওনাও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকিদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
প্রতারণার মূল হোতা সমিতির সর্বশেষ সভাপতি ও ম্যাক্সিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানসহ তৎকালীন সহসভাপতি এইচএম আমিরুল ইসলাম, সম্পাদক আসাদুজ্জামান তপন, যুগ্ম-সম্পাদক মো. সোলাইমান সারোয়ার, কোষাধ্যক্ষ মো. ফজলুর রহমান ও কার্যকরী সদস্য খায়রুল বাশার সজল। এদের মধ্যে হাবিবুর রহমান জেলে থাকলেও বাকি পাঁচ সদস্য পলাতক। অভিযোগ রয়েছে, বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
সর্বশেষ অবস্থা জানতে কথা হয় ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির বিনিয়োগকারী সদস্য ইসহাক আলী মোল্লাহর সঙ্গে। তিনি  বলেন, মাসিক লভ্যাংশ পরিশোধের শর্তে ম্যাক্সিমে ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। সমিতির কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর সমবায় অধিদফতরের কাছে টাকা ফেরতের আবেদন করেও পাচ্ছি না।
আরেক বিনিয়োগকারী সদস্য আমিরুল হক  বলেন, মাসিক লভ্যাংশ পাওয়ার শর্তে ম্যাক্সিমে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। কিছুদিন সুযোগ-সুবিধা পেলেও পরে আটকে যায়। এরপর তো সরকার ম্যাক্সিমের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেয়। আশা করেছিলাম, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকার আমাদের টাকা বুঝিয়ে দেবে। প্রায় চার বছর অতিবাহিত হলেও আমরা টাকা পাচ্ছি না, সম্ভাবনাও দেখছি না। শুনেছি প্রভাবশালী কিছু সদস্যকে ম্যাক্সিমের কিছু সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের টাকা কবে ফেরত পাব, সে ব্যাপারে কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমানতকারীদের চাপের মুখে ম্যাক্সিমের ৬ সদস্যের পরিচালনা পরিষদের পাঁচজন ২০১২ সালেই পদত্যাগ করেন। পরে বন্ধ করে দেয়া হয় সমিতির প্রধান কার্যালয়সহ সব শাখা। ২০১৩ সালের মার্চে সমবায় অধিদফতর ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির আগের কমিটি বাতিল করে অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করে। সমিতির প্রধান কার্যালয় খুলে দেয়া হয়। শুরু হয় সদস্যদের তালিকা প্রস্তুত, সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, সমবায় অধিদফতরের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ম্যাক্সিম সমিতি আইনবহির্ভূতভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। সমবায় অধিদফতরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও চরম উদাসীনতার জন্য গ্রাহকরা তাদের প্রাপ্য থেকে এখন বঞ্চিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল ম্যাক্সিম ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে ম্যাক্সিম সমবায় সমিতি নিবন্ধন পায়। প্রথমে সমিতির কর্ম এলাকা ছিল রমনা, মতিঝিল, পল্টন ও খিলগাঁও। ২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি সমিতির উপ-আইন সংশোধন করে সমিতির কর্মপরিধি বাড়িয়ে সমগ্র ঢাকা জেলা করা হয়। একই বছর ৯ ডিসেম্বর পুনরায় উপ-আইন সংশোধন করে সমিতির কর্ম এলাকা ঢাকা বিভাগে বিস্তৃত করা হয়। দ্রুততম সময়ে ম্যাক্সিমের অগ্রসরের পেছনে সমবায় বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। সমিতির শাখা বাড়ানো থেকে শুরু করে সদস্য সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো বালাই ছিল না। সবই হতো সমিতির পরিচালকদের ইচ্ছেমতো। বেশিরভাগ শাখার অনুমোদন না নিয়ে চালানো হয় সমিতির কার্যক্রম। সমবায় অধিদফতরের চোখের সামনেই চলে ম্যাক্সিমের এ অনিয়ম।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির পরিচালনা পর্ষদ গ্রাহকদের টাকা আবাসন প্রকল্প, ইলেকট্রুনিক্স প্রকল্প, দোকান ক্রয়, সুপারশপ প্রকল্পে বিনিয়োগ দেখালেও মূলত এসব ছিল কাগজপত্রে। গ্রাহকদের টাকা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূতভাবে ম্যাক্সিম গ্রুপে বিনিয়োগ করা হয়। এছাড়াও সমিতির সদস্যদের বিলাসী জীবনেও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়।
সমবায় বিভাগের তদন্তে দেখা যায়, সমিতির ১২৯ কোটি ২২ লাখ টাকা ম্যাক্সিম গ্রুপে সরিয়ে নেয়া হয়। তবে তদন্তে ম্যাক্সিম গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির নামে ৮ হাজার ২৮৫ শতাংশ জমির দলিলের খোঁজ পাওয়া যায়। এসব জমির ক্রয় মূল্য ৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এর বাকি ৬০ কোটি ৭০ লাখ টাকা বিনিয়োগের কোনো রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি। এছাড়া সমিতির কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর অফিসের অগ্রিম বাবদ ১ কোটি ৭০ লাখ, হাতে নগদ ২ কোটি ১১ লাখ, ব্যাংকে ২ কোটি ৪১ লাখ টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সমবায় বিভাগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অনুমোদনক্রমে ১ হাজার ১১৩ জন আমানতকারীকে ৩৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ১১০ শতাংশ এবং ৪ হাজার ৮০০ বর্গফুট জায়গা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সমিতির প্রভাবশালীদের মুখ বন্ধ করার জন্য এই কর্ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ২০১৪ সালে কয়েকজন গ্রাহকের সমিতির পরিচালনা পরিষদের সদস্যের বিরুদ্ধে রমনা থানায় করা মামলা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে ঢাকা জজকোর্টে অভিযোগপত্র দেয়। ওই মামলায়ই সমিতির এমডি হাবিবুর রহমানকে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি পাঁচ পরিচালকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
সমিতির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সমবায় অধিদফতর একের পর এক অ্যাডহক কমিটি গঠন করলেও সমিতির সদস্যদের বকেয়া পরিশোধের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে অধিদফতরের হেঁয়ালিপনার সঙ্গে উদাসীনতাই ফুটে উঠছে বারবার।
ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির সদ্য বিদায়ী অন্তর্বর্তী কমিটির সভাপতি ও ফরিদপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা আখিরুল আলম  বলেন, গ্রাহকদের টাকা বুঝিয়ে দেয়ার মতো সম্পদ ম্যাক্সিমের রয়েছে। সেগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা গেলে অর্থ বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির নতুন অন্তর্বর্তী কমিটির সভাপতি ও ঢাকা জেলা সমবায় কর্মকর্তা আবুল খায়ের (এখনও দায়িত্ব বুঝে নেননি)  বলেন, আমাকে ১২০ দিনের জন্য ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখনও দায়িত্ব বুঝে নিতে পারিনি। এ ব্যাপারে কাজ চলছে। হিসাব বুঝে নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যতটুকু কাজ করা সম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে করার চেষ্টা করব। তবে এই সময়ের মধ্যে ম্যাক্সিমের জটিলতা নিরসন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
এ প্রসঙ্গে সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক আবদুল মজিদ  বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছি অল্প কিছুদিন হয়েছে। এখনও সব সমিতির বিষয় বুঝে উঠতে পারিনি। তবে ম্যাক্সিম সমবায় সমিতির বিষয়ে খোঁজখবর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান।

 

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

1 × 1 =