শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএসের দিক থেকে গত বছরের প্রথমার্ধের চেয়ে চলতি বছরের প্রথমার্ধে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ১২ ব্যাংক খারাপ করেছে। তার বিপরীতে আয় বেড়েছে ১৮ ব্যাংকের। সেই হিসাবে গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ব্যাংক ভালো আয় দেখিয়েছে।নিয়ম অনুযায়ী, সম্প্রতি তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো তাদের চলতি বছরের অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেসব আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ব্যাংকগুলোর আয়সংক্রান্ত এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রকাশিত অর্ধবার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের সঙ্গে গত বছরের একই সময়ের ইপিএসের তুলনামূলক চিত্রও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রকাশ করা হয়েছে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) ইপিএসের হিসাবও।প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) সঙ্গে দ্বিতীয় প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনা করে দেখা গেছে তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের মধ্যে ১৫টিরই আয় বেড়েছে। আবার কমেছেও ১৫টির আয়। সেই হিসাবে তিন মাসের হিসাবে আয়ের দিক থেকে ব্যাংকগুলোর পারফরম্যান্স ছিল ভালো-খারাপে সমান সমান। একটি আর্থিক বছরকে তিন মাস করে ভাগ করে একেকটি প্রান্তিকের হিসাব করা হয়। প্রান্তিক প্রতিবেদনগুলো থাকে অনিরীক্ষিত। আর নিয়ম অনুযায়ী, বছর শেষের পূর্ণাঙ্গ হিসাবটি হতে হয় নিরীক্ষিত। যেকোনো একটি ব্যাংক নির্দিষ্ট একটি সময়ে তার সব ধরনের ব্যয়, প্রভিশন ও কর পরিশোধ শেষে যে মুনাফা করে সেটিকে ওই ব্যাংকের মোট শেয়ার সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস হিসাব করা হয়। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে ইপিএস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থিক সূচক। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকটির পারফরম্যান্স তথা ব্যবসায়িক লাভ-লোকসান সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তার ভিত্তিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ কারণে ইপিএসের ওঠানামার সঙ্গে শেয়ারবাজারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শেয়ারের দামেরও হেরফের হয়।এদিকে, আয়ের দিক থেকে তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ব্যাংক ভালো করায় শেয়ারবাজারে ব্যাংক খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও বেড়েছে। যার প্রতিফলন ব্যাংকের শেয়ারের দাম ও লেনদেনে দেখা গেছে। কয়েক দিন ধরে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনে আধিপত্য ছিল ব্যাংক খাতের শেয়ারের। তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের মধ্যে ডিএসইর বাছাই করা কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মাত্র ৫টি। এ পাঁচটি ব্যাংক হলো ব্র্যাক, দি সিটি, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ও পূবালী ব্যাংক।আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইপিএস বৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। গত বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির আয় ১ টাকা ৪৮ পয়সা বেড়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ইপিএস ছিল ৫ টাকা ৬২ পয়সা। চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ টাকা ১০ পয়সায়।ব্যাংকটির আয়ের এ প্রবৃদ্ধির পেছনে তিনটি বড় কারণ ছিল বলে জানালেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন। তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে চলতি বছর আমাদের ঋণ আদায় পরিস্থিতির বেশ ভালো উন্নতি হয়েছে। ঋণস্থিতিও বেড়েছে। পাশাপাশি ঋণমানের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এ কারণে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন কম হওয়ায় আয় বেড়েছে।ইপিএস কমার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে এবি ব্যাংক। গত বছরের প্রথমার্ধের চেয়ে চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় ৫৭ পয়সা কমেছে। সম্প্রতি ঋণ অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান অর্থ কর্মকর্তাসহ (সিএফও) অভিযুক্ত উচ্চ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা পলাতক ছিলেন। সম্প্রতি আদালত থেকে জামিন নিয়ে ওই সব কর্মকর্তা কাজে ফিরেছেন। ব্যাংকটিতে সিটিসেল, রাইজিং গ্রুপ ও অফশোর ব্যাংকিংয়ে বড় ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।এবি ব্যাংক ছাড়া তালিকাভুক্ত আরও যে ১১ ব্যাংকের আয় কমেছে সেগুলো হলো ন্যাশনাল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এর মধ্যে একমাত্র আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে আয় এখনো ঋণাত্মক।গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে আয় কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, গত বছরের চেয়ে আমাদের ব্যাংকের ব্যবসায়িক সাফল্য ভালো। তারপরও প্রভিশন বেড়ে যাওয়ায় ইপিএস কমে গেছে।সার্বিকভাবে তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ব্যাংকের আয় বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে আনিস এ খান বলেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর ঋণ প্রবৃদ্ধি ভালো। ব্যাংকের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডও বেড়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো ভালো করেছে।ইপিএসের দিক থেকে যে ১৮টি ব্যাংক ভালো করেছে সেগুলো হলো ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক। একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেকোনো প্রান্তিকে যেকোনো ব্যাংকের আয়ের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে। সেটি নির্ভর করে নির্দিষ্ট প্রান্তিকে ব্যাংকটির প্রভিশনসহ অন্যান্য আর্থিক বিষয়ের ওপর। তাই এক প্রান্তিকে কোনো ব্যাংকের আয় বেড়ে যাওয়া মানেই তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে, এমনটি নাও হতে পারে। একইভাবে এক প্রান্তিকে খারাপ করলেও অপর প্রান্তিকে এসে আয়ের দিক থেকে বেশ ভালো করারও সম্ভাবনা থাকে যেকোনো ব্যাংকের।