বাজারে কৃত্রিম ডিমের কোনো প্রমাণ নেই গবেষকদের হাতে

0
452

ডিম নিয়ে আতঙ্ক নয়

নকল কিংবা কৃত্রিম ডিম নিয়ে নানা খবর চাউর হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে_ এ খবর অনেকটাই ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ডিম কেনা এবং খাওয়া নিয়ে অনেকে পড়েছেন দ্বিধা আর অস্বস্তিতে। কিন্তু বাস্তবে কৃত্রিম ডিম উৎপাদন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যে কারণে ব্যবসায়িকভাবে প্রকৃত ডিমের সঙ্গে কৃত্রিম ডিমের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই ক্ষীণ। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) গবেষণায় নকল বা কৃত্রিম ডিমের কোনো প্রমাণ মেলেনি। ফেসবুকসহ প্রচারমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের বাজারে ঢুকছে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি চীনের কৃত্রিম ডিম। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বিপজ্জনক এসব নকল ডিম চোরাপথে বাংলাদেশে আসছে বলেও খবর ছড়িয়ে পড়েছে। কৃত্রিম রাসায়নিক দিয়ে তৈরি ডিম, যা দেখতে সাধারণ বা খাঁটি ডিমের মতোই, আর এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী ফার্মের হাঁস-মুরগির ডিমের আড়ালে বাজারজাত করছে এসব নকল ডিম। বাজারে ভোক্তারা আসল ও নকল ডিম চিনতে নাকাল হচ্ছেন। এমন অপপ্রচারে বাঙালির থালা থেকে প্রোটিনের অন্যতম উপাদান ডিম উধাও হওয়ার জোগাড়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিম অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। এর প্রোটিন গুণ অনেক। স্বাদের দিক থেকেও ডিম বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু সেই ডিম যদি কৃত্রিম হয়, তবে তার চেয়ে ক্ষতিকারক আর কিছু হতে পারে না। কৃত্রিম ডিম নিয়ে প্রকৃত তথ্যের চেয়ে গুজব আর ভুয়া তথ্যই বেশি চাউর হচ্ছে। বাজারে কৃত্রিম ডিমের উপস্থিতি প্রকৃতপক্ষে নেই বললেই চলে। অতএব পুষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস ডিম খাওয়া নিয়ে আতঙ্ক কিংবা অস্বস্তিরও কারণ নেই। ডিম নিয়ে অযথা আতঙ্ক নয়।
নকল বা কৃত্রিম ডিম নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফারুক দিন হোসেন ইয়ামিন। তিনি জানান, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বাজার থেকে ডিম সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে তাতে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ তথ্যটি তিনি ফেসবুকে শেয়ার করেন। পরে এ নিয়ে তুলকালাম ঘটে যায়। কেউ কেউ ডিমের ক্ষতিকর উপাদান পাওয়াকে নকল বা কৃত্রিম ডিম বলে প্রচার চালায়। এ গবেষণার বরাত দিয়ে
কেউ কেউ বলতে থাকেন, একটি চক্র চীনের কৃত্রিম ডিম মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করায়। তবে এ বিষয়ে তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, বানানো সম্ভব হলেও কৃত্রিম ডিম ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক নয়।
মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা আতিকুর রহমান নিয়মিত ডিম খেয়ে থাকেন। তিনি বলেন, নকল ডিম বানানো চীনাদের পক্ষে তুচ্ছ বিষয়। চীন পারে না_ এমন কিছু নেই। কম্পিউটারে সার্চ দিয়ে দেখলাম, নকল ডিম তৈরির গোটা প্রক্রিয়াই ইউটিউবে দেখানো হচ্ছে; তখন আর বিশ্বাস না করার কোনো উপায় নেই। একই কথা বলেন ময়মনসিংহের ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ফেসবুকে তিনি নকল ডিমের ছবি দেখেছেন। নকল ডিমের ভিডিও দেখার পর থেকে তার পরিবার ডিম খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হান এ কায়সার ফেসবুকের উদৃব্দতি দিয়ে বলেন, ২০০৪ সাল থেকেই কৃত্রিম ডিম তৈরি হচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘দ্য ইন্টারনেট জার্নাল অব টক্সোকোলজি’র রেফারেন্স দেওয়া হচ্ছে। যদিও সমকালের অনুসন্ধানে এ সাময়িকীতে এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ওই সাময়িকীর সূত্রে বলা হয়, কৃত্রিম ডিম তৈরিতে ব্যবহৃত হয় রাসায়নিক উপাদান ক্যালসিয়াম কার্বাইড, স্টার্চ, রেসিন, জিলেটিন, যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন এ ধরনের ডিম খেলে স্নায়ুতন্ত্র ও কিডনিতে সমস্যা হতে পারে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড ফুসফুসের ক্যান্সারসহ জটিল রোগের কারণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিম নকল হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। নেত্রকোনার কলমাকান্দার উব্দাখালী গ্রামের হাঁসের খামারি জমির উদ্দিন জানান, প্রায়ই তার খামারে কিছু অস্বাভাবিক ডিম পান তিনি, যেগুলোকে ভোক্তারা নকল বলে নিতে চান না। কিন্তু এগুলো প্রকৃত ডিম।
গাজীপুরের শ্রীপুরের দমদমার পোলট্রি খামারি আকরাম হোসেন বলেন, তার খামারেও মাঝেমধ্যে মুরগি কিছু আশ্চর্য ধরনের ডিম দেয়। এর মধ্যে কোনোটা বাঁকা, কোনোটা বেশি শক্ত। আবার কোনো কোনো ডিম দেখতে অন্য রকম। অনেক সময় ডিম ভাঙার পর ভেতরের কুসুমও অন্য রকম দেখায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভোক্তারা এসব অস্বাভাবিক ডিমকেই নকল ডিম হিসেবে মনে করছেন। এগুলো নকল নয়।
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মহসিন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার থেকেই নকল ডিমের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ভারতে এক হালি সাদা ডিমের দাম বাংলাদেশি টাকায় ৩১ টাকা। বাংলাদেশে যার দাম ৩২ টাকা। ফলে ভারত হয়ে নকল ডিম আসার আশঙ্কা নেই। এটি ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক নয়। দেশে উৎপাদিত এক কেজি ডিমের দাম পড়ে ১০৫ টাকা। অথচ যেসব কেমিক্যাল দিয়ে ডিম বানানোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর এক কেজির দাম হাজার টাকারও বেশি। তিনি বলেন, তার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি মিয়ানমারের আকিয়াব, আরাকান ও মন্ডু এলাকা পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শনে সেসব এলাকায় ডিমের এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা ২ কোটি ৭০ লাখ। বর্তমানে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে ২ কোটি ৮০ লাখ পিস। ডিম উৎপাদনে দেশে কোনো ঘাটতি নেই। ঘাটতি না থাকায় নকল ডিম বাজারজাতের কোনো আশঙ্কাও নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০২১ সালে প্রতিদিন ডিমের দরকার হবে ৪৫ কোটি। দেশে প্রতি বছর ১৪ অক্টোবর ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালিত হয়।
ইউটিউবের বরাত দিয়ে পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, কৃত্রিম ডিম সিদ্ধ করলে কুসুম বর্ণহীন হয়ে যায়। ভাঙার পর আসল ডিমের মতো কুসুম এক জায়গায় না থেকে খানিকটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় পুরো কুসুমটাই নষ্ট ডিমের মতো ছড়ানো থাকে। কৃত্রিম ডিম আকারে আসল ডিমের তুলনায় সামান্য বড় এবং এর খোলস খুব মসৃণ। তবে বাস্তবে তিনি এ ধরনের কৃত্রিম ডিম দেখেননি বলে জানান। কৃত্রিম ডিমের পক্ষে তার কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই বলেও তিনি জানান। বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক মশিউর রহমান বলেন, দেশে ডিমের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নষ্ট করতেই ডিম নিয়ে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। নকল ডিমের কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের পোলট্রি শিল্পকে রক্ষায় এ ধরনের অপপ্রচার থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলা হয়েছে। কেউ কৃত্রিম ডিমের বিষয়ে কোনো তথ্য পেলে ওই ফেসবুক পেজে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
নকল ও কৃত্রিম ডিমে বাজার সয়লাব হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ এ নিয়ে গবেষণায় মাঠে নামে। তাদের গবেষণায় ডিম নকল হওয়ার কোনো তথ্যই মেলেনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) পরিচালক ড. জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা বাজার ও খামার থেকে ডিম সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করে তাতে নকল বা কৃত্রিম ডিমের কোনো অস্তিত্ব পাইনি। ডিমে যেসব পুষ্টিকর উপাদান থাকার কথা সেগুলোই পাওয়া গেছে। ডিম নিয়ে অযথা আতঙ্কিত না হয়ে কোনো ডিমকে সন্দেহ হলে বা অস্বাভাবিক বলে মনে হলে সেটাকে সায়েন্স ল্যাবে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো থেকে সবাইকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

9 + 14 =