শোষণমুক্ত বাংলাদেশ যাদের মননে ছিল

0
763

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান টার্গেট। ২৫ মার্চের কালরাত ও যুদ্ধের ৯ মাসে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের। কারণ তাদের মেধা ও মননে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। এই বোধ তারা ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে। তাদের

মননে ছিলো শোষণমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা।
একাত্তরের ডিসেম্বরে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা রাজধানী ঢাকা অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশিয় দোসররা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্র করে।
তাদের লক্ষ্য ছিল লড়াকু বাঙালী জাতি স্বাধীনতা অর্জন করলেও যেন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দুর্বল ও দিক-নির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে। মেধা ও নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাতে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এ নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তারা বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
৯ মাসের যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশিয় দোসররা ঢাকায় মেধাবী ও সাহসী শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের রাতের আঁধারে একে একে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। ভয়াবহ নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত তাদের অনেকের মরদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে।
মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কতজন বুদ্ধিজীবী শহীদ হন- এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।  তবে ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন ও পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজার ৭০ জন।
১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বরে গঠিত শহীদ বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান আর্মির জেনারেল ‘রাও ফরমান আলী এ দেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এ পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে হত্যা করা।’
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাসেম ও ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনায় মূল হোতা। একাত্তরের নভেম্বরের কোনো এক সময় তারা মাদ্রাসা শিক্ষক সংঘের প্রেসিডেন্ট মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসায় বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেই সম্ভবত বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনা করা হয়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার নির্মিত ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রামাণ্য চিত্রে বলা হয়, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক, ২৭০ জন মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজশিক্ষক শহীদ হয়েছেন।’ তবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনার তথ্যানুসারে, হাজারো বুদ্ধিজীবী শহীদ হওয়ার কথা জানা যায়। এদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের ২ জন।
১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহের জন্য তখন বাংলা একাডেমি সব জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেয়। এরপর একাডেমি সিদ্ধান্ত নেয়, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ বিশেষ পেশাজীবীরা ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়।
এছাড়া ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করে পরে তাদের নিয়ে ‘স্মৃতি ‘৭১’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সবশেষ দশম খণ্ডে ‘স্মৃতি ‘৭১’ প্রকাশিত হয়।
একাত্তরের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ১৮ ডিসেম্বরে একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে রায়ের বাজার এলাকায় অর্ধগলিত ও ক্ষত-বিক্ষত মরদেহের একটি গণকবরের সন্ধান পায়। অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল এসব মৃতদেহ। সাংবাদিকরা লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি বন্দীশালা আবিস্কার করেন, যেটি ছিল রাজাকার, আল বদর ও আল শামসদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
১৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ, আবুল খায়ের, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলিম চৌধুরী এবং সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতারের অর্ধগলিত মৃতদেহ সনাক্ত করতে পেরেছিলেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের মৃতদেহ সনাক্ত করা হয় পরের দিন ১৯ ডিসেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক খান, এ এন এম ফাইজুল মাহী, চিকিৎসক এম মর্তুজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলীর মৃতদেহ পরে সনাক্ত করা যায়।
এ রকম মিরপুর ও রায়ের বাজার এলাকা, তেজগাঁওয়ের কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টিবি হাসপাতালসহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও অনেক বধ্যভূমি খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সেখানে পাওয়া অনেক মৃতদেহ পঁচে-গলে যাওয়ায় সনাক্ত করার পর্যায়ে ছিল না। এ সময় সংবাদপত্রগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের (একাত্তরের নভেম্বরের শেষের দিকে ও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপহৃত) নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
মূলত মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়েই চলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এমনকি পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী ১৯৭২ এর জানুয়ারিতেও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চালায়।
অপহৃত ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারকে (পাকিস্তানি বাহিনী তাকে হত্যা করে বলে ধারণা করা হয়) খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। তাকে শেষ দেখা যায় মিরপুরে বিহারি ও পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের ক্যাম্পে। ১৯৭২ এর ৩০ জানুয়ারির পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর চিকিৎসক মনসুর আলীকে হত্যা করা হয় একাত্তরের ২১ ডিসেম্বর।
শহীদদের মৃতদেহ বহনকারী গাড়ির চালক মফিজ উদ্দিনের বক্তব্য অনুযায়ী, তৎকালীন ইসলামি ছাত্র সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পাকিস্তান রেডিও’র কর্মী  আশরাফুজ্জামান খান নিজ হাতে সাত জন শিক্ষককে গুলি করেন। মফিজউদ্দনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই রায়ের বাজার বধ্যভূমি ও মিরপুরের শিয়াল বাড়ির গণকবর থেকে অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশ সনাক্ত করা হয়। তার ডায়েরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জন শিক্ষকসহ গণহত্যার শিকার অনেক বুদ্ধিবীজীর নামের তালিকা ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশিয় দোসরদের হাতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), ড. মুনির চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য),          ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য), ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা), ড. এএনএম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা), হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য), রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য), সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা),    ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), এনএম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা), শরাফত আলী (গণিত), এআরকে খাদেম (পদার্থবিদ্যা), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা),          এমএ সাদেক (শিক্ষা), এম সাদত আলী (শিক্ষা), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), ডা. এম মর্তুজা (আবাসিক চিকিৎসক)।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও আক্রান্ত হয়। তবে হানাদার বাহিনীর যে দল রাজশাহীতে সক্রিয় ছিল কয়েক দিনের মধ্যে তা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এরপর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল শহরে প্রবেশ করে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অবদান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন রাবির গণিত বিভাগের রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) অধ্যাপক হবিবুর রহমান, ভাষা (সংস্কৃত) বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইউম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র।

শহীদ চিকিৎসকরা: অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ),          অধ্যাপক ডা. আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী,               ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক,              ডা. সোলায়মান খান,             ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী,         ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার,                ডা. মনসুর আলী, ডা. এম মোর্তজা,     ডা. মফিজউদ্দীন খান,          ডা. জাহাঙ্গীর,                 ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এসকে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক,     ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক,   ডা. মোসাব্বের আহমেদ,      ডা. আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), ডা. মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)।

অন্য শহীদ বৃদ্ধিজীবীরা: শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক), নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক), সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), মুহাম্মদ আখতার (সাংবাদিক), সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক),   আনম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার),                ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ),               রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক ও দানবীর), যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক),            জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার), মেহেরুন্নেসা (কবি),       ড. আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ),  নজমুল হক সরকার (আইনজীবী), নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক)।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

12 + 18 =