মেয়েদের ফুটবল নতুন দিগন্ত ছুঁয়েছে

0
997

ফুটবলের সৃষ্টিছাড়া চলনবলনে হঠাৎ অল্প সময়ের জন্য বসন্ত উঁকি দিয়েছিল। ছেলেদের বয়সভিত্তিক ফুটবলে দেখা গেছে আলোর রেখা। কিন্তু প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, গৌরব-গ্লানির বিচার যে বড় আপেক্ষিক। শেষ মাসে নারী ফুটবলের চোখ ধাঁধানো রূপের সামনে ফিকে হয়ে গেল পুরুষ ফুটবলের ওই

সম্ভাবনার আলো। শিরোপা হাতে সাফের মাইলস্টোনে দাঁড়িয়ে যেন কিশোরীরা ঘোষণা করছে, নারী ফুটবলই দেশের ফুটবলের মুখ। এখনো উড়ছে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের বিজয় কেতন। এই প্রথম কোনো টুর্নামেন্টে তারা ফেভারিট হয়ে শুরু করে এবং শেষ ম্যাচ পর্যন্ত এই ধারা বজায় রেখে খেলে গেছে। নেপালকে ৬-০ গোলে হারিয়েই তাদের টুর্নামেন্ট উদ্বোধন, এরপর ভুটানের বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয়। লিগের শেষ ম্যাচটি ছিল শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে, এ অঞ্চলের পরাশক্তি তারা। এই হিসাবে মারিয়া-মনিকাদের সামর্থ্য প্রমাণের ম্যাচ এটা। সেটা প্রমাণ করে তারা ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে। ওই ম্যাচের পরপরই ভারতীয় কোচ স্বীকার করে নেন, নারী ফুটবলে বাংলাদেশের বিস্ফোরণের কথা। ফাইনালে তাই ভারত রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে গোল খাওয়া কমিয়েছে, তবে হার এড়াতে পারেনি। পুরো টুর্নামেন্টে একটি গোল হজম না করে বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল প্রথমবারের মতো জেতে বয়সভিত্তিক সাফ ফুটবল শিরোপা। আঞ্চলিক মহিলা ফুটবলে যে ভারতের ‘দাদাগিরির’ সময় ফুরিয়ে আসছে, এ বছরের শুরুতে তার ইঙ্গিত দিয়েছিল সিনিয়র দল মহিলা সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে। শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে লাল-সবুজের মেয়েরা ১-৩ গোলে ভারতের কাছে হেরে রানার্স-আপ হলেও স্থানীয়দের হৃদয় জিতেছিল সুন্দর ফুটবল খেলে। নাম সিনিয়র জাতীয় দল হলেও অধিকাংশই ছিল অনূর্ধ্ব-১৬ দলের ফুটবলার। আসলে দেশের নারী ফুটবল এক দিনবদলের বাঁকে দাঁড়িয়ে। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল হয়ে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন এক প্রজন্ম। তাদের পায়ে সুরভিত ফুটবল ছুটছে নতুন দিগন্তপানে। আগের বছর এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে কৃষ্ণা-মার্জিয়ারা এ বছর খেলেছে মূলপর্বে। সেখানে লড়েছে উত্তর কোরিয়া-জাপানের মতো মহিলা ফুটবলের পরাশক্তিদের সঙ্গে। এই লড়াই জেতা যায় না, তাদের তুলনায় এখনো ‘লিলিপুট’ বাংলাদেশ। তবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দুই দফা লিড নিয়ে শেষমেশ ২-৩ গোলে হারলেও বুঝিয়ে দিয়েছে লাল-সবুজের দলে ‘গালিভারের’ সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। এমন সম্ভাবনা একসময় ছেলেদের ফুটবলেও ছিল। সবই ছিল, ঘরোয়া ফুটবল রমরমা ছিল, খেলোয়াড়দের পায়ে জাদু ছিল, মাঠে দর্শক ছিল। এখন কিছুই নেই। এমনকি জাতীয় দলও নেই! এ বছর সিনিয়র জাতীয় দল নামের কোনো বস্তু ছিল না বাংলাদেশের! কারণ গত বছর ১০ অক্টোবর থিম্পুতে ভুটানের কাছে ৩-১ গোলে হেরে ঐতিহাসিক লজ্জার রেকর্ড করেছিল লাল-সবুজের দল। ভুটানের বিপক্ষে এটা প্রথম হার, তাই সমালোচনার হুঁলে বিদ্ধ হয়েছিল খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা। ওই ভয়েই কিনা ১৩ মাস ম্যাচহীন জাতীয় দল। মাথাব্যথা হলে মাথাটাই কেটে ফেলতে হবে! অথচ মে মাসে যোগ দেওয়া কোচ অ্যান্ড্রু অর্ডও হাঁসফাঁস করছেন জাতীয় দলে অভিষেকের জন্য। এই অস্ট্রেলিয়ান কোচ অবশ্য উপদেষ্টা হয়ে কাজ করেছেন বয়সভিত্তিক ফুটবলে। সুবাদে একটি অর্জন—সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবলে রানার্স-আপ হয়েছে বাংলাদেশ। মূল কোচ হিসেবে সাফল্যটা স্থানীয় কোচ মাহবুব হোসেন রক্সির ঘরেও যাবে। রানার্স-আপ হওয়ার পথে তাঁর দল ভারতের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক জয়ের কীর্তি গড়েছে। এই সময়ের আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে তারা প্রথমার্ধে পিছিয়ে পড়ে ০-৩ গোলে। আরেকটি ফুটবল লজ্জার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তারা। কিন্তু বিরতির পর জাফর ইকবাল ম্যাজিকে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ম্যাচ জেতে ৪-৩ গোলে। দেশের ফুটবলের মরা গাঙে এটি রুপালি ঢেউ হয়ে থাকবে। আরেকটি ভালো ফল আছে কাতারে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাই পর্বে। সেখানে প্রথম ম্যাচ ইয়েমেনের কাছে হারার পর বাংলাদেশ শেষ ম্যাচে স্বাগতিক কাতারের বিপক্ষে জেতে ২-০ গোলে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাইয়েও বাংলাদেশ লড়াই করেছে। তাজিকিস্তানের সঙ্গে ড্রয়ে শুরুর পর ০-১ গোলে হেরেছে উজবেকিস্তানের সঙ্গে। তবে বাকি দুই ম্যাচে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে গ্রুপে তৃতীয় হয়ে বাংলাদেশের যুবারা উঠে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু ফুটবলের চেহারা ফেরানোর তত্পরতা দেখা যাচ্ছে না বাফুফের কর্মকাণ্ডে। গত বছর ১০ ডিসেম্বর সাড়ম্বরে চার বছরের ক্যালেন্ডার ঘোষণা করেছিল তারা। এই ডিসেম্বরে পূর্ণ হয়েছে, মিলিয়ে দেখলে ক্যালেন্ডারে রাখা অর্ধেকেরও বেশি তারা করতে পারেনি। জাতীয় স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপ, জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপ, বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল, জেলা ক্লাব ফুটবল লিগ, জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপসহ আরো বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি শুধু ক্যালেন্ডারেই রয়ে গেছে। আর ওদিকে অতলে তলিয়ে যাওয়ার রেকর্ড করছে দেশের ফুটবল। ফিফা র‌্যাংকিংয়ে ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থান ১৯৭ ছুঁয়ে ফেলেছে!

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twelve + eight =