অজানা কিছু কথা উত্তম কুমারের

0
2471

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি  মহানায়ক উত্তম কুমার  অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়।

সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী একটু বড় হয়ে পাড়ার সমবয়সি কতগুলি বন্ধু নিয়ে আমরাও মাঝে-মধ্যে নাটক করতাম। এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে শাড়ি, বিছানার চাদর ইত্যাদি জোগাড় করে সেফটিপিন দিয়ে ঝুলিয়ে উইংস, স্ক্রিন তৈরি করে নাটক করতাম। কাগজ দিয়ে মুকুট হতো। রাংতা দিয়ে তলোয়ার। আর পাউডার দিয়ে মেকআপ করতাম। কিছুদিনের মধ্যেই আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু, বিশেষ করে দিলীপ মুখার্জি (মুখার্জি বাড়ির ছেলে) একত্রিত হয়ে সেই বিছানার চাদরের মঞ্চের সংস্কার করলাম। কয়েকজনের সামনে সেবারই প্রকাশ্যে থিয়েটার করলাম আমরা। নাটক ছিল কবিগুরুর মুকুট। পাড়ায় ছোট্ট মঞ্চ তৈরি করে অভিনয় করেছিলাম।প্রকাশ্যে মুকুট নিয়েই আমার হাতেখড়ি। যে ক্লাবের মাধ্যমে আমরা মুকুট আসরস্থ করেছিলাম তার নাম দিয়েছিলাম লুনার ক্লাব। এর রকে তার রকে, এ-বাড়ি ও-বাড়ির ছাদে নাটকের রিহার্সাল দিতাম আমরা। আমাদের তখন একটা ঘরও ছিল না। একটা ঘরের জন্য আমরা তখন মরিয়া। এমন সময় মুখার্জিবাড়ির গিন্নি অর্থাৎ দিলীপের মা, আমাদের মাসিমা, একদিন সস্নেহে কাছে ডাকলেন। তারপর তাঁরই বাড়িতে তিনি একটা জায়গা করে দিলেন ক্লাবের জন্য। তখন থেকে আমরা রিহার্সাল দিতে শুরু করেছিলাম সেখানে। থাক সে সব কথা। দিনগুলো কাটছিল বেশি। স্কুলেও সবার কাছে আমি ইতিমধ্যে অনেকটা পরিচিত হয়ে পড়েছি। কয়েকজন মাস্টারমশাই আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কেন ভালোবাসতেন জানি না। কেউ কাউকে অহেতুক ভালোবাসতে জানে না। আমি অন্য অনেক ছেলের মতো স্কুলে গিয়ে কারও সঙ্গে কোনো মনোমালিন্য করতাম না। নিজেকে একটু স্বতন্ত্র রাখার চেষ্টা করতাম। একদিন স্কুলে গিয়ে শুনতে পেলাম, বার্ষিক উৎসব হবে আমাদের স্কুলে। সেই মুহূর্তে আমার মনে আনন্দের দোলা লাগল। গোটা স্কুলে, প্রতি ক্লাসে আসন্ন উৎসব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। উৎসবে কী কী অনুষ্ঠান হবে তাই নিয়ে আলোচনা। কানে এল নাটক হবে। নাটকে অভিনয় করবে ওপরের ক্লাসের ছাত্ররা। সবাই আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। নাটকের কথা শুনেই আমি আনন্দে মেতে উঠলাম, কিন্তু যখন শুনলাম আমাদের সুযোগ নেই তখন আমি ভীষণ মুষড়ে পড়লাম। একটা অস্বস্তি আমাকে ভর করল। আমার কোনো কিছুই আর ভালো লাগত না। বই নিয়ে বসতাম কিন্তু পড়ায় মন বসত না। খুব আশা ছিল নাটকে নিশ্চয়ই আমাদের চান্স দেওয়া হবে। হলো না। আশাহত হলাম। বড়দের ওপর রাগ হলো মনে মনে। মনে হলো সব ক্লাস থেকে দু’একজনকে নিয়েও তো নাটক করা যেত! পরদিন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে স্কুলে গেলাম। স্কুলে ঢুকেই দেখলাম ব্ল্যাক বোর্ডের বড় বড় হরফে লেখা আছে ‘গয়াসুর’ নাটক হবে স্থির হয়েছে। মনটা সেই মুহূর্তে আরও খারাপ হয়ে গেল। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ক্লাসে গিয়ে বসলাম। ক্লাসে গিয়ে শুনলাম ছোট গয়াসুরের ভূমিকা নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছেন নাটকের কর্তকর্তারা। কে করবে? কাউকে দিয়েই তো চলছে না। একটি ছেলেকে এইমাত্র ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে, সেও কৃতকার্য হতে পারল না। তা হলে উপায়? আমাকে তবু ওঁরা ডাকছেন না। অস্বস্তি আমার ক্রমশ বেড়ে চলল। তবু সাহস করে ‘আমি পারব স্যার’ কথাটা বলতে পারছি না। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বসে আছি। এমন সময় স্বয়ং হেডমাস্টার মশাই! তিনি সরাসরি আমাদের ক্লাসে এলেন। উঠে দাঁড়ালাম! সবাই ভাবছি পড়ার ব্যাপারে কিছু হয়তো বলতে চান। আমরা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলাম। রাশভারী স্বরে বললেন, তোমরা বোসো আমরা সবাই একসঙ্গে বসলাম। বাঁকা চোখে দেখলাম হেডমাস্টার মশাই আমারই দিকে এগিয়ে আসছেন। আমার কাছে এসে বেশ শান্ত স্বরে তিনি বললেন, কী করছ?উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, পড়ছি স্যার বেশ! কথাটা উচ্চারণ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। গোটা ক্লাসটার উপরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, তোমাদের ক্লাসে কি এমন কেউ আছে যে ওই ছোট গয়াসুর-এর রোলটা ভালো করতে পারো? হেডমাস্টার মশাইয়ের কথাটা আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাহ করে তুলল। সবাই চুপচাপ। গোটা ক্লাসটা মুহূর্তে যেন বোবা হয়ে গেছে। নিস্তব্ধ। একটা পিন পড়লে শব্দ শোনা যাবে, ঠিক এমনি ধরনের নিস্তব্ধতা। আমার বুকের মধ্যে দপ দপ করছিল। আর নিজেকে সংযত করতে পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম, আমি পারব স্যার-

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twenty − eighteen =