সব অর্জনই ব্যর্থ হবে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধান না হলে

5
580

ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশকে দুই অংকের  উঠিয়ে আনতে সংস্কার পদক্ষেপ নেয়া হয় ২০১৬ সালের শেষ প্রান্তে। এ সংস্কার পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ সম্ভাবনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখনো উদ্যোগ নেই। এজন্য গঠিত ন্যাশনাল কমিটি ফর মনিটরিং ইমপ্লিমেনটেশন অব ডুয়িং বিজনেস রিফর্মসকেও (এনসিএমআইডি) এখনো কার্যকর ও শক্তিশালী করা হয়নি। ব্যাংকি খাত নিয়েও আমরা সমস্যা মোকাবেলা করছি।

এ সমস্যার সমাধান করতে না পারলে সব অর্জনই ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে গতকাল আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় এ অভিমত উঠে আসে। বৈঠকে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ এখন ধারাবাহিক উন্নয়নের ধারায় আছে। গত দুই অর্থবছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে। এ অগ্রগতি টেকসই করে উন্নয়নকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে বাংলাদেশ। বিনিয়োগ তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে নেয়া হয়েছে সংস্কার উদ্যোগ। কিন্তু এসব সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে; রয়েছে আমলাতন্ত্রজনিত দুর্বলতাও। সার্বিকভাবে দেশের আমলাতন্ত্র এখনো উন্নয়নের পরের ধাপের জন্য প্রস্তুত নয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ডুয়িং বিজনেস’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইর ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ। সূচনা বক্তব্য রাখেন পিআরআইর নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের সিনিয়র ইকোনমিস্ট অ্যান্ড প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. এম মাশরুর রিয়াজ প্রমুখ। ড. সাদিক আহমেদ উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য অনুযায়ী এ প্রবৃদ্ধি এখন সঠিক পথেই আছে। এদিকে সামষ্টিক অর্থনীতির অগ্রগতিও ইতিবাচক। অগ্রগতির এ ধারা ইতিবাচক হলেও রফতানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। শ্লথ হয়ে পড়েছে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার। বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণও নগণ্য। এর অন্যতম কারণ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস র্যাংকিং। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন ও বড় আকারের সংস্কার পদক্ষেপের মাধ্যমে এ র্যাংকিংয়ে ভারত ও ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশের আঞ্চলিক প্রতিযোগী বেশ এগিয়ে গেছে। সার্বিকভাবে ব্যবসায়িক পরিবেশের দিক থেকে প্রতিযোগী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা বেশ দুর্বল। এ সময় ড. সাদিক জাতীয় নির্বাচনের বছরকে সামনে রেখে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কিছু ক্ষেত্র; যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও আইনবিষয়ক সংস্কারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, রফতানি বৈচিত্র্য, বাণিজ্য সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়েও গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে এগুলোর সমাধান করতে হবে। তাহলেই আমরা ২০২১ ও ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান বলেন, আমার হিসাব বলে ২০২১ সালের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের প্রয়োজন হবে ৪০-৫০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ। স্যামসাং তিন বছর ধরে বাংলাদেশে বিনিয়োগের চেষ্টা করেছিল। এর পর তারা ভিয়েতনামে কারখানা স্থাপন করে। ২০১৬ ও ২০১৭— এ দুই বছর ধরে ভিয়েতনামে স্যামসাংয়ের কারখানা সচল আছে। এর মধ্যে যে কারখানাটি বাংলাদেশে স্থাপন করার কথা ছিল, তার রফতানি আয় এখন ৬০ বিলিয়ন ডলার। এ আয় বাংলাদেশের করার কথা ছিল। কেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করল না, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা, নীতি ও আইন আছে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নেও নেয়া হয়েছে অনেক পদক্ষেপ, কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, আমাদের হাতে আর সময় নেই, এখনই ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, জাতিগতভাবে আমরা অনেক আশাবাদী। কিন্তু আমাদের উন্নয়ন টেকসই করার বিষয়ে অনেক কিছু করার আছে। প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দরকষাকষির বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ভারতের যে ডেস্ক বাংলাদেশ বিষয়ে কাজ করে, সে ডেস্কের কর্মকর্তা বাংলাদেশের কাজের ধরন সম্পর্কে সবকিছু জানেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারত নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তা যখন দরকষাকষির জন্য এগিয়ে আসেন, তখন দেখা যায় তিনি তিন মাস হলো অন্য ডেস্ক থেকে এসেছেন। আমাদের দরকষাকষির সক্ষমতার ঘাটতি আছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বাজারের কোনো যোগ নেই। এ কারণে ৪৭ শতাংশ বেকার বসে থাকে। আর আমরা বিদেশ থেকে লোক নিয়ে এসে কাজ করাই। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের সিনিয়র ইকোনমিস্ট অ্যান্ড প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. এম মাশরুর রিয়াজ তার বক্তব্যে বিআইডিএর পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেন, সব ধরনের সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের পর আমাদের ফিডব্যাক প্রয়োজন। এ ফিডব্যাক দিতে পারেন ব্যবসায়ীরা। ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত চার শতাধিক সংস্কার পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কোনো বিষয়ে যখনই কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, নিম্ন পর্যায়ের আমলাদের কাছে গিয়ে সবকিছু আটকে যায়। কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই, এ ধরনের সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। সাবেক সচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে শুধুই কোয়ান্টিটি বিবেচনা করা হচ্ছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করতে না পারলে কিছু হবে না। এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ফারুক আহমেদ বলেন, আমাদের আমলাতন্ত্র পরবর্তী ধাপের উন্নয়নের জন্য প্রস্তুত নয়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

19 + eighteen =