সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার দৌলখাড় উচ্চ বিদ্যালয়টি নানা অযতœ, অনিয়ম আর অবহেলায় চলছে। এতে স্কুলের শিক্ষার্থীরা যেমন কাঙ্খিত সাফল্য পাচ্ছেনা, তেমনি প্রতিষ্ঠানটির আয়ের উৎস লোপাট হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এদিকে স্কুলের প্রভাবশালী ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা পাশ্ববর্তী প্রস্তাবিত একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসার ১৭ শতাংশ এবং এক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের ৬’শতাংশ জায়গায় অবৈধভাবে দোকান-পাট, ভবন গড়ে সেখান থেকে আয়ের সিংহ ভাগ লুটে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার দৌলখাড় ইউনিয়নের দৌলখাড় বাজারে ১৯৬৯ সালে স্থানীয় গ্রামবাসীর সহযোগীতা নিয়ে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সমাজ সেবক প্রয়াত হাজী সৈয়দ বজলুর রহমান প্রকাশ সৈয়দ আলী মিস্ত্রি। তিনি স্কুলটির জন্য পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে ৬২ শতাংশ জায়গা বরাদ্দ দেন। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহযোগী জহিরুল কাইয়ুম চৌধুরী এই স্কুলটির উদ্বোধন করেন। ১৯৮২ সালে স্কুলটি এমপিওভূক্ত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্থানীয়দের সহযোগীতায় স্কুলটিতে দিন দিন বাড়তে থাকে শিক্ষার্থী সংখ্যা। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ হাজার ৩’শ ২০ জন। স্কুলটিতে বর্তমানে ২৭ জন শিক্ষক, অফিসসহকারীসহ অন্য ৩ জনসহ মোট ৩০ জন কর্মরত আছেন। ২০১৭ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসিতে ১৭৬ জন অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয় ১৪০ জন। জেএসসিতে ২৯৩ জন অংশ নিয়ে ১৯৬ জন উত্তীর্ণ হয়। শতকরা পাশের হার ৬৭ %। আগামী এসএসসি পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি থেকে ২৩৫ জন পরীক্ষার্থী টেষ্ট পরীক্ষায় অংশ নিলেও পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের যোগ্যতা অর্জন করে ১৩৫ জন। স্কুলটির একাধিক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় অনেক গ্রামবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্কুলটির শিক্ষকরা নিয়মিত পাঠদান না করায় দিন দিন এসএসসি ও জেএসসিতে উত্তীর্ণেও সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তারা আরো জানান, শ্রেনী কক্ষে শিক্ষকরা পাঠ দান না করে কোচিং বানিজ্যে ব্যস্ত সময় পার করে। যদি কোন শিক্ষার্থীরা কোচিং করতে অপারগহয় তাহলে তাদের বার্ষিক পরীক্ষাসহ অন্যান্য পরীক্ষায় কৌশলে ফেল করানোরও অভিযোগকরেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী জানান, দৌলখাড় উচ্চ বিদ্যালয়ের গেম টিচার আবু ইউসুফের নেতৃত্বে চলছে এই কোচিং বানিজ্য। তার অন্যান্য সহযোগীরা হলেন, লক্ষণ কুমার, আবুল কাসেম, ওমর ফারুক ও অফিস সহকারী কামাল উদ্দিন। আর এই কোচিং বানিজ্য করে প্রতিমাসে তারা লাখ লাখ টাকা আয় করছে। অথচ শ্রেনী কক্ষে পাঠদান করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনিহা। এমনও অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের যে, ক্লাস চলাকালীন সময়ে অনেক শিক্ষক স্কুলের পাশে দোকানে চা পানসহ আড্ডা দেন। সুত্র আরো জানায়, ওই সিন্ডিকেটের চাপে অনেকটা বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীরা কোচিং করছে। এদিকে স্কুলটির পাশেই একই এলাকার তমিজ উদ্দিন নামের এক সমাজ সেবক একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসার জন্য ১৭ শতাংশ জায়গা দান করেন। সুত্র জানায়, ওই জায়গাটির দান পত্রে দাতা উল্লেখ করেন যদি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে এই জায়গাটির মালিকানা ভোগদখল করবে তার ওয়ারিশরা। তবে বাস্তব অবস্থা এখনো সেই ১৭ শতাংশ জায়গার উপর এবতেদায়ী মাদ্রাসা চালু হয়নি। স্থানীয় সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দের ওই জায়গাটি এখন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রভাবশালীরা দখল করে আছেন। সেখানে তারা ১৪/১৫ টি দোকান-ঘর তৈরী করে এককালীন প্রতিটি দোকান থেকে লাখ টাকা ছাড়াও প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা ভাড়া আদায় করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র আরো জানায়, স্কুলটির পাশেই রুহুনি কুমার পাল নামের এক হিন্দুর ৬’শতাংশ সম্পত্তিও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা দখল করে নেয়। এবিষয়ে মামলা হলে আদালত জমির মালিক রুহুনি কুমার পালকে সম্পত্তি ফেরত দানের নির্দেশ দিলেও সেটা কার্যকর হয়নি। উল্টো এই ভূমির উপর সরকারী বরাদ্দের টাকায় দৌলখাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে একটি ভবন নির্মান করেছে ম্যানেজিং কমিটির লোকজন। সুত্র জানায়, প্রায় ৩ মাস পূর্বে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত হয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে এক কর্মকর্তা এসে ভবন নির্মানের বিষয়ে আপত্তি জানালেও প্রভাবশালীরা সেটা কর্নপাত করেনি। স্থানীয় একাধিক শিক্ষার্থী আরো জানান, আসন্ন এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপেও স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে। এছাড়াও টেস্টে এক বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার বিনিময়ে ৪-৫ হাজার টাকা আদায়েরও অভিযোগ করেন। বিষয়টি জানতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম খলিলের সাথে কথা বললে তিনি সকল অনিয়মের বিষয় অস্বীকার করেন। এছাড়াও এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে টেষ্ট পরীক্ষায় যে সকল শিক্ষার্থী দু/এক বিষয়ে ফেল করেছে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সুপারিশে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তাদেরকে আগামী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোচিং বানিজ্য একেবারেই নিষেধ। আসন্ন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে যে সকল শিক্ষার্থী টেষ্ট পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হয়েছে তাদের কিভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ দিয়ে ফরম ফিলাপ করিয়েছেন সেটা তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে অবহিত করবো।