চন্দ্রমহল ইকোপার্কে বিনোদনের অন্তরালে ঘটছে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়

0
870

আল-আমিন পলাশঃ বাগেরহাট জেলার রণজিতপুরে চন্দ্র মহল ইকোপার্কে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকদের আগমন ঘটছে। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পর্যটকদের আগমনে ইকোপার্কটি থাকছে সরগরম। পর্যটন মৌসুমে এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং বিদেশী পর্যটকরা আসেন। বর্তমানে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ চিত্তবিনোদনের জন্য হাজির হন এই ইকোপার্কে। তাদের জন্য রয়েছে প্রায় সকল ব্যাবস্থা। পর্যটকদের চাহিদা পূরনের জন্য ইকোপার্কের মধ্যেই গড়ে উঠেছে ৮-১০টি বিভিন্ন প্রকারের রেস্তরা। বেশ পরিপাটি করেই সাজানো হয়েছে পার্কটি। জানা যায়, ২০০২ সালে চন্দ্র মহলের প্রতিষ্ঠাতা সেলিম হুদা তার স্ত্রী নাসিমা হুদা চন্দ্রার নামানুসারে প্রায় ৩০ একর জমির উপরে এই ইকোপার্কটি তৈরী করেন। দীর্ঘ বছরের নির্মান কাজ শেষে বর্তমানে এটি দর্শণার্থীদের মনোরঞ্জনের উপযোগী হয়ে উঠেছে। তবে এটির কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি। এখানে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হলো চন্দ্র মহলের মূল মহলটি। তাজমহলের নির্মান ব্যায় চন্দ্র মহলের নির্মান ব্যায়ের কয়েক হাজার গুন বেশি হলেও ভালবাসার যে কমতি নেই সেটি বোঝা যায় প্রতিষ্ঠাতার এমন গ্রাম্য পরিবেশে এতবেশি অর্থব্যায়ের মানসিক অবস্থা থেকেই। ধারনা করা স্বাভাবিক যে আর্থিক সামর্থ থাকলে তিনি একটি মমতাজ মহলের মত প্রাসাদ নির্মান করতেন। তার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস-ই স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন বলে দর্শণার্থীদের ধারনা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে তিনি যে পার্কটি তৈরি করেছেন তা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিরল। চন্দ্র মহলের সৌন্দর্য দেখে যে কোন পর্যটক মুগ্ধ হবেন। বিশেষ করে প্রখর রোদের আলো যখন মহলের উপরি অংশের সোনালী অংশে পরে তখন এটি দেখে মনে হয় দামী ধাতব পদার্থে নির্মিত হয়েছে মহলটি। মহলটি পানি দ্বারা বেষ্টিত। মহলে পৌছানোর জন্য পানির নিচ থেকেই নেয়া হয়েছে পাকা রাস্তা। রাস্তার মাঝপথে গেলেই দর্শণার্থীদের চোখে পরবে পুরু কাঁচের উল্টো পাশের বড় বড় মাছ। স্থানীয় লোকদের ধারনা শীত মৌসুমে সুন্দরবন দেখতে লাখ লাখ মানুষের আগমন ঘটে। আর সুন্দরবন যাওয়ার পথে চন্দ্র মহলের অবস্থান বিধায় সুন্দরবনের দর্শণার্থীদের একটি বড় অংশ চন্দ্র মহল দেখতে আসেন। যে কারনে অন্যান্য পার্কের তুলনায় চন্দ্র মহলে পর্যটকদের ভীর কিছুটা বেশি। বর্তমানে এই ইকোপার্কে প্রবেশ পত্রের আর্থিক মূল্য নির্ধারন করা হয়েছে ৪০ টাকা। স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জানা যায়, এই প্রবেশ মূল্যের অর্থের কোন অংশই প্রতিষ্ঠাতা গ্রহন করেননা। পুরো টাকাটাই ব্যায় করা হয় ইকোপার্কের ভ্যাট, ইউ-পি ট্যাক্স, ইউ-পি ট্রেড লাইসেন্স, ভূমি রাজস্ব, চন্দ্র মহলের লাইসেন্স ফি, পরিবেশের ছাড়পত্র , কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ বিল, চিড়িয়াখানার পশু-পাখির খাবার ও চিকিৎসা এবং ইকোপার্কের সংস্কার ও উন্নয়নমূলক কাজে।

 

পর্যটকদের জন্য এখানে নির্মান করা হয়েছে নানান প্রস্তর শিল্প, মৃত্তিকা শিল্প, বাশ ও বেত শিল্পের মানুষ ও প্রাণীর মূর্তি। মাটি দ্বারা নির্মিত হয়েছে পল্লী সংস্কৃতির নানান স্মৃতিকথা, গ্রামীণ নারীর জীবনযাত্রার বিমূর্ত ছবি ফুটে উঠেছে এ শিল্পে। জেলে, কৃষক, ধোপা ইত্যাকার নানান পেশাজীবী গ্রামীণ মানুষের মধ্যযুগের জীবনযাত্রা কেমন ছিল তার ধারনা দিতেই নির্মিত হয়েছে এ মাটির শিল্প। এখানে রয়েছে পানির উপর বাঁশের তৈরি কুটির ও রেস্তরা, ছোট ছোট দিঘীগুলোতে রয়েছে মাছ চাষ, পুকুরের মধ্যে ইট-সিমেন্টের তৈরি কাকড়া ও ঝিনুক, পানসী নৌকা, ১৯৭১ সালের রাজাকারের জন্য কৃত্তিম ফাঁসির মঞ্চ, ডাইনোসরের মূর্তি, কৃত্তিম রেল লাইন, বাঘ-ঘোড়া-হরিণের মূর্তি। পর্যটকদের জন্য রয়েছে পিকনিক স্পট। একটি কাঠের তৈরি বড় ঘর ও তার পাশে রয়েছে রান্নার সকল ব্যাবস্থা। দর্শণার্থীরা নিজেদের মত করে যাতে পিকনিক করতে পারে সে বিবেচনা করেই এ ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে। ইকোপার্কের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান প্রকারের সবজি চাষ, প্রচুর ফলজ বৃক্ষও রোপন করা হয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির আম চাষ। পার্কের চারধারে লাগানো হয়েছে অসংখ্য নারিকেল গাছ। আর এই বিভিন্ন প্রকারের গাছ ও সবজি চাষই ইকোপার্কের মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।

বণ্য প্রাণীদের সাথে পরিচয় করানোর জন্য এখানে আনা হয়েছে অনেক প্রজাতির পশু-পাখি। এদের মধ্যে বানর, বনবিড়াল, হরিণ, তিতপাখি, তুর্কী মুরগী, সাদা ময়ূর, বক, বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর ঈগল, মদন টাক পাখি, সাদা ঘুঘু-হাস পাখি, পেঁচা, বেজী, কবুতর, কোয়েল, কুমির ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। পার্কের মূল মহলের মধ্যে রাখা হয়েছে নানান প্রতœতত্ত্ব। এদের মধ্যে বিশেষকরে দেশী-বিদেশী পুরনো মুদ্রা, ডাক টিকিট, যুদ্ধের অস্ত্র, বহুকাল আগের তৈরি ঘড়ি, প্রার্থণার অলংকার, ধর্মীয় পুরাকীর্তি, সিঁদুর দানী, পাথরের আসবাবপত্র, বিভিন্ন রঙের পাথর, শত বছরের পুরনো কলেরগান, সবচেয়ে ছোট গ্রামোফোন, বিরল পান্ডুলিপি, বাঁশ পোকা, বিভিন্ন প্রজাতির মৃৎ শিল্প, বিভিন্ন প্রকার ক্ষুদ্র পতঙ্গ, পাতা পোকা, ১৭০০-১৮০০ সালের পিতলের চুলের কাটা, রুপার চায়ের পাত্র, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কোরআন শরীফ, আড় বাঁশি ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।

এতসব সত্যেও পার্কের মধ্যে চোখে পরে কিছু অসংগতি। দুপুরের দিকে দর্শনার্থীদের ভির কিছুটা কম থাকে। এসময় কিছু উশৃংখল ছেলে মেয়েদেরকে পার্কের শেষ দিকের বেঞ্চিতে অশোভন অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে পার্কের পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ পাশের ভেরী বাধের উপরের বেঞ্চিতে ও আবছা আলো-আধারির মাঝে কিছু লোকের চলাফেরা পর্যটকদের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। মানুষের বেচে থাকা, জীবনের বিকাশের এবং সভ্য সামাজিক জীবন যাপনের জন্য যে সকল উপকরন একান্তই অপরিহার্য তার মধ্যে চিত্তবিনোদন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিশুর সুস্থ সাভাবিক জীবন যাপনের জন্য সুস্থ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ একান্ত প্রয়োজন। বলা হয়ে থাকে শিশু জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের আঁশিভাগ সম্পন্ন হয়। পর্যটকদের এক-পঞ্চমাংশ-ই শিশু। পার্কের এই অশোভন পরিবেশ শিশুর মানসিক বিকাশের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়াতে পারে। শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনে নির্মল চিত্তবিনোদনের ব্যাবস্থা করা সমাজের দায়িত্ব। এই সকল কোমলমতি শিশু-কিশোরদের কথা চিন্তা করে পার্কের পরিবেশ সুস্থ স্বাভাবিক রাখা পার্ক কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 × two =