অনুসন্ধানি প্রতিবেদন-১ নামে সোনার দোকান, নেপথ্যে সুদ আর চোরাই স্বর্ণের কারবার

1
998

স্টাফ রিপোর্টার ঃ
চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন। থরেথরে সাজানো রয়েছে বাহারি ডিজাইনের স্বর্ণালঙ্কার। সবাই জানে জুয়েলারির দোকান। অথচ দোকানের এই আলোর পেছনে চোরাই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় আর চড়া সুদে চলছে জমজমাট স্বর্ণ বন্ধকির ব্যবসা। নীতিমালা নেই, বৈধতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন, অনেকে হচ্ছেন প্রতারিত। আশুলিয়ার কুমকুমারী বাজারের মা বাবা জুয়েলারি দোকানে কোটি টাকার এই ব্যবসা এখন সরগরম। এই জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের মালিক টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার হারিয়া গ্রামের দুলু মিয়ার পুত্র আরিফুল ইসলাম (২৮) এক সময়ে যার নুন আনতে পানতা ফুরাতো অথচ তিনি আজ অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক। কয়েক বছর আগেও অন্যের স্বর্ণের দোকানে দোকানে ক্যারিগরের কাজ করে সংসার চালাতেন। এমনকি অভাবের তাড়নায় বিএনপি জোট সরকারের আমলে এই আরিফুল ইসলাম টাকার লোভে বিএনপির বিভিন্ন মিছিল মিটিং-এ যেতো। আর এই আসা-যাওয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র এক শীর্ষ নেতার সাথে গড়ে উঠে সখ্যতা। যার কারণে বেশ কয়েক বছর আগে রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্র সাভারের আশুলিয়ার কুমকুমারী বাজারে মা বাবা জুয়েলারি নামক দোকান দিয়ে যার অন্তরালে সুদ বন্ধকি আর চোরাই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় করে আলাদীনের যাদুর চেরাগ পাওয়ার মত রাতারাতি কৌটিপতি বনে গেছে। তিনি আজ নামে-বেনামে অবৈধভাবে গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার অর্থ স¤পদ। এই অর্থ স¤পদের আয়ের উৎস কোথায় এই প্রশ্নের ঝড় বইছে কুমকুমারীবাসীর মাঝে।
কুমকুমারী বাজারের জনৈক এক জুয়েলারি ব্যবসায়ী জানায়, স্বর্ণের বাজার দর বেড়ে যাওয়া ও অলঙ্কারের ব্যবহার কমে যাওয়ায় মা বাবা জুয়েলারির মালিক আরিফুল ইসলাম জুয়েলারির আড়ালে স্বর্ণ বন্ধকিসহ চোরাই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয়ে মেতে উঠেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণকারী বন্ধকির অর্থ ফেরত দিতে পারেনা বলে লাভজনক এ ব্যবসায় প্রাসার ঘটাচ্ছে তিনি। এছাড়াও জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ডিলিং লাইসেন্স নিয়ে স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় ও সংরক্ষণ করার বিধান থাকলেও তা মানছে এই ব্যবসায়ী। ব্যবসাটি লাভজনক হওয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছে। এব্যাপারে সরেজমিনে কুমকুমারী বাজারে জুয়েলারির মালিক আরিফুল ইসলাম কাছে ঘটনার সত্যতা জানতে গেলে সে সাংবাদিক টের পেয়ে সটকে পড়ে। পরবর্তীতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সে সংবাদপত্রে তার বিরুদ্ধে কোন প্রকার সংবাদ প্রকাশ না জন্য অনুরোধ জানায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চোরাই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় ও বন্ধক রেখে চড়া সুদে টাকা ধার দেয়ার ব্যবসাটি দীর্ঘ সময় ধরে করে আসছে আরিফুল। কিন্তু এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপদ-আপদে মানুষ বন্ধক রেখে টাকা ধার নিয়ে থাকে। কিন্তু সুদের চক্রে পড়ে অনেকেই সময়মতো আসল ও সুদ পরিশোধ করতে পারে না, খুইয়ে ফেলে তার সহায়-স¤পদ। স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায় দেশে কোনো আইন বা নীতিমালা না থাকায় এই প্রতিষ্ঠান এর মালিক আরিফুল ইসলাম গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে দিনের পর দিন পার পেয়ে যাচ্ছে। অবৈধ ব্যবসার কারণে স্থানীয় মাস্তানরাও ভাগ পাচ্ছে টাকার। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের চোখও এই চোরাকারবারী ব্যবসায়ীর দিকে। ১৯৮৭ সালের ভোগ্যপণ্য আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে স্বর্ণ ব্যবসার জন্য একটি ডিলিং লাইসেন্স দেয়া হয়। এতে স্বর্ণের ক্রয়-মজুদ ও বিনিময়ের কথা বলা আছে। প্রতি বছর ২৫০ টাকার বিনিময়ে সনদ নবায়নের সুযোগ ছিল এতে। কিন্তু ২০০১ সালের পর জেলা প্রশাসন এসব লাইসেন্স আর নবায়ন করছে না। ওই লাইসেন্সেও স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে যে কোনো হারেই সুদের ব্যবসার কোনো নিয়ম নেই। আর চোরাই স্বর্ণ ক্রয়ের তো কোন প্রশ্নই আসেনা। স্বর্ণ বন্ধক ব্যবসা স¤পূর্ণ বেআইনি। সঙ্গতকারণেই গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা এবং সুদ আদায় বন্ধ করতে কঠোর নীতিমালা এবং নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি। আশুলিয়ার এক ব্যবসায়ী স্বর্ণের দোকান ব্যবসায়ের আড়ালে রমরমা সুদ আর চোরাই, ছিনতাইকৃত স্বর্ণ কিনে পুরাদমে বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। শতকরা ৫০ টাকা করে মাসিক সুদে চক্রবৃদ্ধি হারে গ্রহকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন থেকে এ চড়া সুদ বাণিজ্যও চালিয়ে আসছে। তার কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিলেও বন্ধক হিসাবে টাকার দ্বিগুণ স্বর্ণ জমা দিতে হয়। অসহায় মানুষ তাদের সর্বশেষ সম্বল তার হাতে উঠিয়ে দিয়ে এ সুদ বাণিজ্যের শিকার হয়। তিন মাস মেয়াদ উত্তীর্ণ ঋণের ফলে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে গ্রাহকের সমুদয় স্বর্ণ লোপাট করে দেয়া হয়। এ বন্ধকে কোনো ধরনের রশিদ না দেয়ার ফলে গ্রাহকদের কোন প্রমাণ হাতে থাকে না। যার ফলে বছরের পর বছর লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব ফাঁকি। তথা নিরীহ লোকজনকে সর্বস্বান্ত করার মাধ্যমে এ ব্যবসা পরিচালিত করে আসছে। কিন্তু এরপরেও নিরীহ নিপীড়িত সাধারণ মানুষকে রক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সদয় দৃষ্টি নেই। সক্রিয় ব্যবস্থা নেই। সরকারের আইন শুধু প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের পক্ষে। বলাবাহুল্য, এ বৈষম্য কোনোভাবেই বরদাশতযোগ্য নয়। (চলবে)

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

14 − 9 =