পরিবহন শ্রমিকরা যেন মালিকদের লোভের ফাঁদে পড়েছে

0
562

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তায় মূল সড়ক ধরে চলতে চলতে কানে এলো, ‘অ্যাই মহাখালী, মহাখালী…।’ লেগুনা থামিয়ে যাত্রীদের ডেকে চলছিল চালকের কিশোর সহকারী। হাত ধরে, ঘাড় ধরে যাত্রী তুলছিল সে। মগবাজার মোড়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন ৬০ বছর বয়সী বাসচালকের সহকারী মো. হেলাল। তিনি বলেন, মালিককে জমা দিয়ে নিজের কিছুই থাকে না। রাজধানীর ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর পথে লেগুনার চালকের সহকারী বেলাল মিয়া সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কখনো যাত্রী ডেকে তোলে, কখনো গাড়িটি চালায়। দৈনিক আয় গড়ে ৩০০ টাকা।

চালকের সহকারী হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সে করছে। গুলিস্তান থেকে নিউ মার্কেট পথে লেগুনায় চালকের সহকারী থেকে ‘চালক’ বনে গেছে মো. হাসান। ঝিগাতলা, নিউ মার্কেট, আগারগাঁও থেকে ৬০ ফুট, মিরপুর ১ থেকে ১০ নম্বর, মহাখালী-মিরপুর পথে লেগুনায় এভাবেই শিশু-কিশোররা যুক্ত হয়েছে পরিবহন খাতে। তাদের প্রশিক্ষণ নেই, লাইসেন্স থাকার জন্য ১৮ বছর হতে হয়, সে বয়সও হয়নি। এমন চিত্র গোটা রাজধানীতেই। রাজধানীর অন্য একটি রুটের লেগুনা চালকের সহকারী কিশোর বয়সী শরীফ হোসেন বলে, ‘গাড়ি চললে দিনে ট্যাহা পাই। না হলে পেট চলে না। কখনো দিনে ২০০ পাই, কখনো ১৫০ টাকা।’ জানা গেল, বাস, লেগুনার মতো পরিবহনের শ্রমিকদের মধ্যে হেলপার বা চালকের সহকারী ছাড়াও মিস্ত্রি, কন্ডাক্টরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের নিয়োগপত্র নেই। বেতনের কাঠামো নেই। ২৮ বছর ধরে গাড়ি চালালেও নিয়োগপত্র পাননি বলে জানান, চালকের সহকারী হেলাল। ঢাকার পরিবহন শ্রমিক নেতা মো. হানিফ খোকন বলেন, প্রভাবশালী চক্র, অদক্ষ চালক ও মুনাফালোভী গাড়ি মালিকদের জন্য রাস্তায় বিশৃঙ্খলা ভাঙা যাচ্ছে না। এদিকে নৈরাজ্যের শিকার হয়ে যাত্রী ও পথচারীরা মারা যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে পরিবহনকর্মীরাও, সেদিকে তাদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও সচেতন নন। তাদের একটাই কাজ, চাঁদা জোগানোর মেশিন হিসেবে পরিবহন শ্রমিকদের ব্যবহার করা। এমন বিরূপ বাস্তবতার মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। পরিবহন সংগঠনগুলোর হিসাবে, রাজধানীতে ৬০ শতাংশ মালিক চালকের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে বাস চালায়। ২০ বছরের পুরনো বাসগুলোর বড় অংশই চুক্তিতে চলায় গাড়ি বেপরোয়া চলল কি না তা খেয়াল রাখেন না মালিকরা। চালকের কাছ থেকে দিনে বা সপ্তাহে পাওনাটা শুধু বুঝে নেন। মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনে মূল সড়কে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসের চালক বাবুল মিয়া বলেন, দিনে তিন হাজার টাকার মধ্যে এক হাজার ৮০০ টাকাই মালিককে দিতে হয়। গ্যাস কিনতে হয় ৩০০ টাকার। নিজের দুই বেলা খাবার, সহকারীর মজুরি দিয়ে নিজের ৩০০ টাকাও থাকে না। চাবি হাতে নিলে যানজট হলেও মালিককে টাকা দিতে হয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরো সড়ক পরিবহন খাতে প্রশিক্ষণহীন, লাইসেন্সবিহীন চালকের আধিপত্য বাড়ছে। তাদের পেছনে আছেন শীর্ষ পরিবহন নেতারা। চাঁদা আদায়ের জন্য চালকদের ব্যবহার করে পরিবহন নেতা ও মালিকরা মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। শ্রম আইনে চালকদের আট ঘণ্টা খাটানোর কথা থাকলেও দ্বিগুণ সময় পর্যন্ত খাটানো হচ্ছে, যাতে বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি লাভ ওঠে। এ জন্য চালকদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। কারণ নিয়োগপত্র থাকলে নায্য অধিকার না পেলে চালকরা আদালতে যেতে পারবে, মালিক বা পরিবহন নেতাদের প্রভাব কমে যাবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘পৌনে এক কোটি পরিবহন শ্রমিক আছে দেশে। একটি গাড়ির সঙ্গে থাকে চালক, তার সহকারী, মিস্ত্রিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিক। থাকে বাস কাউন্টারের বিক্রেতাও। আমাদের ফেডারেশনের দুই শতাধিক শ্রমিক ইউনিয়নের পরিবহন শ্রমিকরা তাদের কাজের সময় আট ঘণ্টা নির্ধারণ, নিয়োগপত্র দেওয়া, বিশ্রামাগার স্থাপন, দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে; কিন্তু ৯০ শতাংশ মালিকই দাবি মানে না। বাস বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের পেট চলে না। বেশির ভাগ স্থানে খোরাকিও মেলে না।’ দেশের সড়কগুলোতে প্রাণহানি ও অঙ্গহানি বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত চার মাসে এক হাজার ৮৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় দুই হাজার ১২৩ জন নিহত এবং পাঁচ হাজার ৫৫৮ জন আহত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালের একই সময়ে দুর্ঘটনা ১.০৬ শতাংশ, নিহত ১.৪৪ শতাংশ, আহত ৮.৩১ শতাংশ বেড়েছে। তিতুমীর কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের মৃত্যুতে মানুষের কান্না থামতে না থামতেই পা হারানো রোজিনা কাঁদিয়ে চলে গেল গত রবিবার। অ্যাপোলো হাসপাতালে সংকটে আছেন পা হারানো চালক রাসেল। অঙ্গহানি হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালে কাতরাতে কাতরাতে প্রাণও যায় আহতদের। এভাবে সড়কে হত্যা বা দুর্ঘটনা বাড়ছেই। গবেষক, পর্যবেক্ষক, প্রত্যক্ষদর্শীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বলছেন, সড়কে হত্যা এখন পরিণত হয়েছে গণহত্যায়, দুর্ঘটনা অনেক কম। চালকরা সরাসরি গাড়ি উঠিয়ে দিচ্ছে আরেক চালকের পায়ের ওপর। গত শনিবার দুপুরে এমন দৃশ্যও প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে পথচারীদের। অনিয়মের প্রতিবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে গ্রীনলাইন পরিবহনের একটি বাসের চালক কবির হোসেন মাইক্রোবাসের চালক রাসেল সরকারের পা কেটে নিয়েছেন গাড়ি চালিয়ে দিয়ে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মোটরসাইকেল আরোহী মাশরুর আলম বলেন, ‘আমি দেখছিলাম ছেলেটা বাসটিকে থামতে বলছে, কিন্তু থামেনি। তাঁর পায়ের ওপর দিয়ে বাসটি চালিয়ে দেয়। আর পা আলাদা হয়ে যায়। কবির তো আধুনিক বিলাসী গাড়ি চালাত; কিন্তু তার পরও তার আচরণ ছিল জেদি।’ দেশজুড়ে চালকরা গাড়ি চালাচ্ছে বেপরোয়াভাবে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অনুসন্ধান মতে, ৬১ শতাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দায়ী থাকে গাড়িচালক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্যানুসারে, নিবন্ধিত গাড়ির মধ্যে ১০ লাখ গাড়িই চালানো হচ্ছে লাইসেন্সহীন চালক দিয়ে। গাবতলী-সদরঘাট রুটের ৭ নম্বর লোকাল বাসের চালক ছদরুদ্দিন গাবতলীতে মিনিবাসের ভেতরেই ঘুমান। বাড়ি বরিশালের মুলাদীতে। গত রবিবার সকালে চলন্ত গাড়িতেই তিনি বলেন, ‘আমাদের নিয়োগপত্র লাগে না। দিনে এক হাজার ৮০০ টাকাও হয় না। মালিককে এক হাজার ২০০ দিতে হয়। সব খরচ করে নিজের ৫০০ টাকাও থাকে না। বেশি ট্রিপ দিতে পারি না। তাই রাস্তা খালি পেতে বেশি দৌড়াতে হয়। না হলে তো পেট চালানো যাবে না। দিনে তিনটি ট্রিপ দিতে পারি। ১৫০ টাকা করে পাই প্রতি ট্রিপে।’ শ্রম আইনে মোটরযান শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া এবং দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করানোর বাধ্যবাধকতা আছে। তবে ছদরুদ্দিনকে ১৬ ঘণ্টাও বাসে থাকতে হয়। চালকদের কেন নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, ‘নিয়োগপত্র না দেওয়ার বড় কারণ চালকরা সব শর্ত পূরণ করতে পারে না। বেশির ভাগ চালক ওস্তাদের কাছে গাড়ি চালানো শিখেছে। তাাদের বড় অংশ নিরক্ষর। চুক্তিই বেশি বোঝে। তবে অভিজাত কম্পানির গাড়িতে শিক্ষিত চালকদের নিয়োগপত্র দেওয়া শুরু হয়েছে।’ গতকাল মহাখালী বাস টার্মিনালে বৃষ্টিতে জড়সড় হয়ে বাসের ভেতর জিরিয়ে নিচ্ছিলেন ঢাকা-রংপুর রুটের বাসচালক সবুজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে রংপুর যেতে ১২ ঘণ্টা লাগত, এখন ১৬ ঘণ্টাও লাগছে। গাড়ি তো আর থামিয়ে চালানো যায় না। দুই দিন পর ঘুমাচ্ছি। মাসে ১৫ দিন গাড়ি চালিয়ে নিজে ৫০০ টাকাও জমাতে পারি না। আটজনের সংসারে একা রোজগার করি। সংসার চলব ক্যামনে?’ তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালে ট্রাকের ভেতরে আধো ঘুমে থাকা আবুল হোসেন বলেন, ‘ট্রিপ মারলে টাকা পাই। মাসিক বেতন নেই।’ আসবাবপত্র, চাল, ডাল, সিমেন্ট, রড ইত্যাদি পরিবহন করেন ভোলার মো. জামাল মিয়া (৪০)। ১০ বছর ধরে গাড়ি চালান। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে একটি পিকআপ ভ্যান কিনেছেন। প্রতি সপ্তাহে তাঁকে মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হয়। ফলে দিনে দু-একটি ট্রিপ মারার কথা থাকলেও ঋণের ছয় ট্রিপ মারতে হয়। জামাল জানান, সপ্তাহের বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে বেশ ক্লান্ত থাকতে হয়। দূরে ট্রিপ নিয়ে গেলে রাস্তায় ঘুমাতে হয়। সেখানেও পুলিশের ঝামেলা। তিনি সরকারের কাছে মহাসড়কে গাড়ির চালকদের জন্য বিশ্রামারগার তৈরির দাবি জানান। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের ১০ ঘণ্টা কাজের পর ২৪ ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার নিয়ম থাকলেও মালিকের নির্দেশে তাদের যেকোনো সময় ছুটে চলতে হয়। মালিকের চাহিদা মেটাতে চোখে ঘুম নিয়েই তাদের আবার গাড়ি নিয়ে ছুটতে হয়। তিনি বলেন, মালিকদের দায়দায়িত্ব এবং বেতন বা মজুরির নির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় তাদের অন্যায্য দাবি মেনে নিয়েই গাড়ি চালাতে হয় চালকদের। আইএলওর পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও বিলসের উপদেষ্টা রায় রমেশ চন্দ্র বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা না থাকা, প্রশিক্ষণের অভাব এবং প্রতি ট্রিপ অনুসারে মজুরি সড়ক দুর্ঘটনায় বড় প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, দেশে ট্রাক, বাস, প্রাইভেট কার, ট্যাক্সিসহ ৭৫ লাখের বেশি পরিবহন রাস্তায় চলে। গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। সরকার একটি জাতীয় কারিকুলামের মাধ্যমে সারা দেশে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তৈরি করার উদ্যোগ নিতে পারে।  বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের মহাসচিব জেড এম কামরুল আনাম বলেন, দুর্ঘটনার বেশির ভাগ কারণ হিসেবে দেখা যায় রাস্তায় অতিরিক্ত ট্রিপ মারার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া ড্রাইভারের চেয়ে হেলপার দিয়ে অনেক বেশি গাড়ি চালানো হয়। বিলসের জরিপ মতে, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা গত চার বছরে সর্বোচ্চ হয়েছে। আহতদের কাটছে দুর্বিষহ জীবন। কর্মস্থলে শ্রমিকের নিরাপত্তা নেই, ক্ষতিপূরণও তেমন পায় না। নাখালপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম আলম ঢাকা-হালুয়াঘাটে রুটে বাস চালাতেন। ২০০৪ সালের এক রাতে হালুয়াঘাট থেকে ঢাকা ফেরার পথে ফুলপুরে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ডান হাত কাটা পড়ে তাঁর। কোনো ক্ষতিপূরণ কেউ দেয়নি তাঁকে। গত বছর ৭৮৪ জন শ্রমিক নিহত হয়। এর মধ্যে পরিবহন শ্রমিকই ৩০৭ জন। মহান মে দিবস আজ। শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও অধিকার আদায়ের দিন। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে দেশে-বিদেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই বাংলাদেশে আজ পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। সে হিসেবে এটি সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি দিবস পালন করতে নানা কর্মসূচি নিয়েছে সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 × 4 =