জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে শ্রম আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, শ্রম আইন বাস্তবায়ন ছাড়া এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হলে বাংলাদেশের শিল্প খাত ঝুঁকিতে পড়বে বলে আবারও সতর্ক করে দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
ঝুঁকি মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। গতকাল মঙ্গলবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপে বক্তারা এসব মন্তব্য করেন। ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ এবং এসডিজি বাস্তবায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রমমান বাস্তবায়নের ক্রমবর্ধমান তাগিদ’ শীর্ষক ওই সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। সংলাপে অর্থনীতিবিদ, কারখানা মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। সংলাপে বাংলাদেশ লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসির খান অভিযোগ করেন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) কারণে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সময়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নাসির খান বলেন, ইন্সপেক্টরদের সামলান। আমরা আর পারছি না। ওরা কারখানায় গিয়ে মামলা দেওয়ার হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করে। টাকা না দিলে এমডি, জিএমদের নামে মামলা ঠুকে দেয়। তিনি বলেন, এই খাতে দুর্নীতি বন্ধ করা জরুরি। ১৯৮৫ সালে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ছিল ১০০ কোটি ডলার। এখন তাদের রপ্তানি আয় ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আমরা দুর্নীতির কারণে এগোতে পারছি না। জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কারখানার মালিকরাও নিয়ম মানেন না। যদি নিয়ম মানতেন তাহলে ঘুষের প্রশ্ন আসত না। আগে মিল মালিকদের সৎ হতে হবে। ডে-কেয়ার সেন্টার করার কথা, করেন না। আপনারা অনিয়ম করেন বলে ওরা মামলার ভয় দেখায়। ওরা মনে করে মামলা দিয়ে লাভ কি? মামলা দিলে মন্ত্রীকে ফোন করবেন। মালিক অনেক ক্ষমতাবান। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করলে কোনো লাভ হবে না। তার চেয়ে টাকা পেলে মন্দ কী। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এমন জায়গায় যেন না যাই, কিছু প্রতিষ্ঠান শ্রম আইন বাস্তবায়ন করতে পারছে, আবার কেউ করতে পারছে না। এখন বহুপক্ষীয় শ্রমমানের ইস্যুটি আলোচনায় আসছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি হলেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মসংস্থার বাড়েনি। আবার যে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, তাও শোভন নয়। শ্রম মানের উন্নয়নে কাজ করা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়েরও তাগিদ দেন তিনি। বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পোশাক খাতে এ বছর রপ্তানি আয় ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এর পেছনে মূল অবদান শ্রমিকদের। তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা যথেষ্ট কাজ করেছি। সেফটি ইস্যুতে আমরা পিছিয়ে আছি এটা ঠিক না। রানা প্লাজার পর দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।’ তিনি বলেন, ‘চুরি বা খোয়া যাওয়া সমস্যা থাকার পরেও বর্তমানে আমরা সব ফ্যাক্টরির দরজা খোলা রাখি। যে কেউ ইচ্ছা করলে পর্যবেক্ষণে আসতে পারেন। তাহলে কেন বলব সেফটি ইস্যুতে আমরা পিছিয়ে আছি? নেতিবাচক প্রচারণাটা ঘর থেকেই শুরু হয়। আমরা যা করিনি তা বলতে বলছি না, কিন্তু যা করেছি তা স্বীকার করুন।’ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নীতিমালা অনুযায়ী শ্রম আইন বাস্তবায়ন ও শ্রম অধিকার রক্ষায় নজর দিতে হবে। শুধু গার্মেন্টস নয়, সব ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রম অধিকার রক্ষায় সমান গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় এসডিজি অর্জন কিংবা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ অর্থহীন হয়ে যাবে। ফলে এর সুফল ভোগ করা যাবে না। আলোচনায় শ্রমিক নেতারা বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের অনেক সুবিধাই থাকবে না। তবে আইএলওর নীতিমালা অনুযায়ী শ্রম আইন সংশোধন, বাস্তবায়ন ও শ্রম অধিকার রক্ষা হলে বাংলাদেশও পাকিস্তান কিংবা শ্রীলঙ্কার মতো জিএসপি প্লাসের আওতায় রপ্তানিতে সুবিধা পাবে। তাঁরা বলেন, শ্রমিকের জন্য অনেক কথা হয়, কিন্তু বাস্তবতা কী তা পর্যালোচনা করা দরকার। যেসব সুবিধার কথা আলোচনা হয়, তার কতটুকু শ্রমিকের কাছে যাচ্ছে তাও দেখা দরকার। কত শ্রমিক রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যানও দরকার। শ্রমিক নেত্রী ও গার্মেন্টসের জন্য গঠিত মজুরি বোর্ডের সদস্য শামসুন্নাহার ভূঁইয়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বোর্ডের আওতায় আনার দাবি জানান। তিনি বলেন, কাউকে মূল স্রোতের বাইরে রেখে এগিয়ে যেত পারব না। মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার আগে আমরা শ্রম অধিকার নিয়ে খুব একটা কাজ করিনি। তবে আমরা অল্প সময়ে যা করেছি তা অনেক দেশের চেয়ে ভালো। শ্রম আইনের সংশোধন এবং নতুন করে ফের সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া সহজ করাসহ এ লক্ষ্যে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন তিনি।