রাজধানীর বেশির ভাগ শপিং মল ও মার্কেট অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে

0
717

রাজধানীর বেশির ভাগ শপিং মল ও মার্কেট অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে। এ তালিকায় যেমন সিটি করপোরেশনের মার্কেট রয়েছে, তেমনি রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় বড় বেসরকারি মার্কেটও। ফায়ার সার্ভিস সরেজমিনে রাজধানীর ১৩০৫টি বিপণিবিতান পরিদর্শন করে দেখেছে এর মধ্যে ১৩০০টিই রয়েছে অগ্নি ঝুঁকিতে। মারাত্মক ঝুকিতে রয়েছে ৬২২টি মার্কেট ও শপিংমল।

 

এ নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতারা কিছুটা শঙ্কিত হলেও মালিক সমিতি একেবারেই উদাসীন নিরাপত্তার বিষয়ে। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল ও আইনের দুর্বলতার কারনে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া বারবার সংশ্লিষ্ট মার্কেট কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেয়া হলেও প্রতিকারের কোন উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। অধিক ঝুকিপূর্ণ শপিংমল /মার্কেটগুলোকে অক্সিজেন সিলিন্ডার, পানির রিজার্ভ ট্যাংক, বালুভর্তি বালতি ও রেসকিউ সিঁড়িসহ অন্যান্য অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রীও নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে রাজধানীর শপিং মল ও মার্কেট সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থায় থাকায় যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র মতে, অগ্নি ঝুঁকি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ও অগ্নি আইন (২০০৩) অনুযায়ী ৩০টির বেশি নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করার কথা। কিন্তু কেউ এসের তুয়াক্কা করেন না। ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, শপিংমল ও মার্কেটগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। কোনো নিয়ম-নীতিই সেখানে মানা হয়নি। আগুন নির্বাপক যন্ত্র নেই, পানি নেই, নেই ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম। কোথাও আগুন লাগলে নিজস্ব ফাইটাররা যাতে ফায়ার সার্ভিস আসা পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে সেই ব্যবস্থা শপিং মার্কেটগুলোয় নেই। মার্কেটের ট্রান্সফরমার, জেনারেটর, বিদ্যুতের সাবস্টেশন সব এক জায়গায় করা। নিরাপত্তার জন্য এগুলো আলাদা আলাদা জায়গায় বসানো উচিত। কেননা এগুলো একই জায়গায় হওয়ায় আগুন লাগলে সব পুড়ে যাবে। এতে আগুন নেভানোর কোনো উপকরণ থাকলে সেগুলো কাজ করবে না। ফায়ার অ্যালার্মও বাজবে না। তিনি আরো বলেন, রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ঢাকার বড় বড় শপিং মল ও রেস্টুরেন্টগুলোর ভবন তৈরির সময় বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, আমরা জরিপ করার পাশাপাশি তাদের সতর্ক করছি। ভয়াবহ দুর্ঘটনা হলে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে সে বিষয়েও আমরা তাদের অবগত করছি। কিন্তু এ সতর্কবার্তাতেই শুধু কাজ হবে না, মালিক-ব্যবসায়ী সবাইকেই সচেতন হতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের জনবল অভাব রয়েছে। আমাদের হাতে আইনগত ক্ষমতা নেই। সে জন্য ম্যাজিষ্ট্রেট প্রয়োজন। আমরা চেষ্টা করছি সকলকে সচেতন করতে। সূত্র বলছে, মার্কেট বা শপিং মলের বাইরের চাকচিক্য দেখে মনে হতে পারে কেনাকাটার জন্য এত ছিমছাম কোনো জায়গা হতে পারে নাকি? সেটা হোক নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, বঙ্গবাজার কিংবা ফুলবাড়িয়া মার্কেট। কিন্তু বাইরের চাকচিক্যময় শপিং মলের আড়ালে লুকানো সত্য হলো এসব শপিং মল আগুনের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। একবার আগুন লাগলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল। আগুনে জীবন বিপন্ন হতে পারে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স রাজধানীর এ রকম ৬২২টি শপিং মল/মার্কেটগুলো নিয়ে এমনই হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, মার্কেট বা শপিং মলে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা থাকা খুবই জরুরী। কিন্তু যারা মার্কেট তৈরি করেন তারা এ বিষয়টি গুরুত্ব দেন না। আর কখনো যদি করাও হয় পরে রক্ষনাবেক্ষন করা হয় না। এ জন্য বড় ধরনের হুমকি থেকে যায় মার্কেট বা শপিংমলগুলোতে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত হতে পারেন না যে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটবে না। কোন মার্কেটে অগ্নিকান্ডের পর ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা নিঃশ্ব হয়ে যান। তখন দেখার কেউ থাকে না। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর মার্কেটগুলোর অধিকাংশই নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করেনি। অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে মার্কেটগুলোতে নেই অক্সিজেন সিলিন্ডার, পানির রিজার্ভ ট্যাংক, বালুভর্তি বালতি ও রেসকিউ সিঁড়িসহ অন্যান্য অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রী। বিশেষ করে পুরনো মার্কেটগুলোর বেশির ভাগেই নেই অগ্নিনির্বাপণে কোনোরকম ব্যবস্থা। আর নতুন মার্কেটগুলোর অনেকগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখা গেলেও পানির রিজার্ভ ট্যাংক বা আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দেখা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলোর মধ্যে বারিধারা ফায়ার ষ্টেশনের আওয়াত যে সব মার্কেট রয়েছে এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে-বনানী সুপার মার্কেট, আবেদ আলী মার্কেট, বারিধারা নতুন বাজার দোকান মালিক সমবায় সমিতি মার্কেটহাকিম টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্স। এছাড়া মিরপুর টাওয়ার, সিটিক্লাব মার্কেট মিরপুর, বিক্রমপুর প্লাজা শ্যামপুর, আলম সুপার রমার্কেট জুরাইন, রহমত প্লাজা কদমতলী। তেজগাঁও ফায়ার ষ্টেশনের অধীনে রয়েছে-বড় মগবাজারের বাটা বাজার, মগবাজার প্লাজা, বিশাল সেন্টার শপিং মল, রাজ্জাক প্লাজা শপিং কমপ্লেক্স, সাউদিয়া সুপার মার্কেট। মোহাম্মদপুর ফায়ার ষ্টেশনের আওতায় যে সব মার্কেট অগ্নিঝুকিতে রয়েছে এর মধ্যে বসুন্ধরা সিটি ডেভেলপমেন্ট, সানরাইজপ্লাজা, ধানমন্ডী প্লাজা, সিটি টাওয়ার, আলতা প্লাজা ও ব্র্যাক আড়ং। ডেমরা ও খিলগাঁও ফায়ার ষ্টেশনের আওতা যে সব মার্কেট অগ্নিঝুকিতে রয়েছে এর মধ্যে মোল্লা আলী মার্কেট বাজার ডেমরা, সেলিম মার্কেট, মালেক প্লাজা, দেওয়ার সুপার মার্কেট, মুগদা বড় বাজার, আলম সুপার মার্কেট। লালবাগ, হাজারীবাগ ও পলাশী ফায়ার ষ্টেশনের আওতায় যে সব মার্কেট অগ্নিঝুকিতে রয়েছে এর মধ্যে গোল্ডেন শপিংমল, হোসেন ম্যানশন, চকবাজার সাধারন ব্যবসায়ী সমিতি মার্কেট, নীলক্ষেত সিটি কর্পোরেশণ মার্কেট ও চকবাজার সিটি কর্পোরেশ মার্কেট। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনা রোধে মার্কেটের অবস্থান, ব্যবহূত ফ্লোরের আয়তন, সাধারণ সিঁড়ির প্রশস্ততা, অগ্নিনির্বাপণ কাজে সিঁড়ির ব্যবস্থা, জরুরি প্রস্থানের সিঁড়ির সংখ্যা, প্রতি তলায় সেফটি লবির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা। এ ছাড়া ছাদে ওঠার সিঁড়ির সংখ্যা বেশি থাকা, ছাদের দরজা খোলা রাখা, বহির্গমন দরজার সংখ্যা বেশি রাখা, আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ ট্যাংক মজুদ (৫০ হাজার গ্যালন) রাখা, ১০ হাজার গ্যালনের ওভার হ্যাড ওয়াটার ট্যাংক থাকা বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক তারে কনসিল ওয়্যারিং থাকা, বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ বক্স ও ডিমান্ড বক্সের নিরাপদ অবস্থানে থাকা এবং প্রতি পয়েন্টে ৫ কেজি পরিমাণের সিওটু ফায়ার এক্সটিংগুইসার সংরক্ষণ করা, স্মোক ও হিট ডিটেক্টর রাখা এবং মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের নিয়মিত অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ করানোর কথা। কিন্তু এসব নিয়ম কেউ মানছেন না আর মানার জন্য আইন প্রয়োগও হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

20 − 12 =