আওয়ামী লীগে নারী নেতৃত্ব

0
1348

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠালগ্নের ৭৭ বছর পেরিয়ে এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সর্ববৃহৎ দল। প্রগতিশীল, উদার সংস্কৃতি, বিজ্ঞানমনস্ক ও আদর্শিক চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আত্মপ্রকাশ করেছিল রাজনীতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ দলটিই ১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার বিচক্ষণতা, মেধা, দক্ষতা ও সফল নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের রোল মডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে।
আওয়ামীলীগকে দেশের সর্ববৃহৎ দল হিসেবে গড়ে তোলার মূলে পুরুষের পাশাপাশি নারী কর্মীদের গৌরবোজ্জ্বল অবদান রয়েছে। যুক্তফ্রন্টেই প্রথম। আমেনা বেগম, বদরুন্নেছা বেগম, বেগম আনোয়ারা খাতুনসহ কয়েকজন নারী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগে, বিশেষত ১৯৬৬ সালে ৬-দফা আন্দোলনে দলের সকল নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন আমেনা বেগম। এছাড়া আমেনা বেগম, বদরুন্নেছা বেগম, বেগম আনোয়ারা খাতুন, অধ্যাপিকা নূরজাহান মোরশেদ, দওলতুন্নেছা খাতুন-সহ প্রমুখ নারী নেতৃত্ব সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর আওয়ামী কার্যক্রমে নেমে আসে স্থবিরতা। ম্রিয়মাণ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে দলটির মূল দায়িত্বে আনা হয় নারী নেত্রী সাজেদা চৌধুরী ও জোহরা তাজউদ্দীনকে। কিন্তু তারাও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। নেতৃত্ব ক্রাইসিসে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালে ১৭ মে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে নেতৃত্ব অর্পণ করা হয় দলটির চরম বিপর্যয় ঠেকানোর স্বার্থে। তিনি সুদৃঢ়ভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির চেয়ারকে শক্তিশালী করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি ৩৭ বছর ধরে পার্টির কর্ণধার হিসেবে আওয়ামী মতাদর্শের রাজনীতিকে বলিষ্ঠ হাতে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। সপ্তম, নবম, চলমান দশম জাতীয় সংসদে তিন টার্মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে তিনি হয়েছেন জননন্দিত। বর্তমান বিশ্বে ১০০ জন মর্যাদাসম্পন্ন নেতাদের মাঝে ৪৭তম অবস্থানে রয়েছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নের জোয়ারে প্রবাহিত করে বিশ্ব অঙ্গনে সফল নারী নেত্রী হিসেবে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সুদক্ষ নেতৃত্বের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন রাষ্ট্র পরিচালনার রন্ধ্রে রন্ধ্রেও অর্জন করেছেন বহু মূল্যবান খেতাব, পদবি ও পুরস্কার। আওয়ামী লীগের ১৯তম কাউন্সিল সম্মেলন হয়েছিল ২০১২ সালে। তখন ৭৩ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১০ জন নারী সদস্য ছিলেন। অতঃপর ২০১৬ সালে অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত ২০তম সম্মেলনে সদস্য সংখ্যা ৮১-তে উন্নীত করা হয়।
নারীবান্ধব এই নেত্রীর পাশাপাশি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, যিনি বর্তমান ও বিগত সরকারের সফল কৃষিমন্ত্রী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন ডা. দীপু মনি। তিনিও নবম জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। জাতীয় সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন যিনি নবম সংসদে স্বরাষ্ট্র, পরবর্তী পর্যায়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন, তিনিও প্রেসিডিয়াম সদস্য। মেহের আফরোজ চুমকি এমপি দশম জাতীয় সংসদে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। একই সংসদে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তারানা হালিমকে পেয়েছি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে। উজ্জ্বল নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করে যাচ্ছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কৃষিবিষক দফতরের দায়িত্ব পালন করছেন ফরিদুন্নাহার লাইলী। মহিলাবিষয়ক সম্পাদকের কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফজিলাতুন্নেচ্ছা ইন্দিরা। ডা. রোকেয়া সুলতানা, শামসুন্নাহার চাঁপা যথাক্রমে স্বাস্থ্য ও জনশক্তি, শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির ৬টি সাধারণ সদস্যপদ অলঙ্কৃত করেছেন সিমিন হোসেন রিমি, তিনি জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, তিনি নবম জাতীয় সংসদের মন্ত্রী ছিলেন, পারভীন জামান কল্পনা তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কামারুজ্জামানের মেয়ে, মেরিনা জাহান তিনি বদরুন্নেছা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ছিলেন, ড. শাম্মী আহম্মেদ, বঙ্গবন্ধু সহচর মহিউদ্দিন আহমেদের মেয়ে, মারুফা আক্তার পপি, সাবেক ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। ২০তম কাউন্সিল অধিবেশনের পর ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতিসহ ১৫ জন নারী সদস্য রয়েছে, যা শতকরা হারে ২০.২৭ শতাংশ, পূর্বের কমিটির তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। সভাপতিসহ চারজন নারী প্রেসিডিয়াম সদস্য, চারজন নারী সম্পাদকীয় সদস্য রয়েছে। ২৮ জনের সদস্য পরিষদে রয়েছে ছয়জন নারী সাধারণ সদস্য, যা শতকরা হারে ২১ শতাংশ। তবে দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে রয়েছে নারী সদস্য ১৯ শতাংশ। এসব সফল নেতৃবৃন্দ নারী নেতৃত্বের উজ্জ্বল বাতিঘর হিসেবে প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের নারী সমাজকে।
নারীরা পারে না, পারবে না-এই অপবাদ থেকে বেরিয়ে এসে আজকাল বহু নারী রাজনৈতিক অগ্রযাত্রায় করছে বিচরণ। কিন্তু এখানে টিকে থাকা ও জায়গা করে নেওয়া সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তবে না নারী নেতৃত্বের তিলক সংগ্রহ করতে হয়। তাই সেলুট জানাই যারা হাজারো প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে অতীতের ন্যায় বর্তমানেও রাজনীতি কর্মী হিসেবে আওয়ামী রাজনীতিতে সফলভাবে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছেন। নারী নেতৃত্বের উপস্থিতি কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল কমিটিতে বৃদ্ধি করার জন্য নানা প্রস্তাব চলছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)’ ৯০-এর খ-এর খ (২) অনুচ্ছেদে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সব স্তরেই ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিবন্ধন প্রথা ২০০৮ সালে চালু করার পর নির্বাচন কমিশন সতর্ক করে দিয়েছে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী কোটা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় নিবন্ধিত দলসমূহের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সুখের খবর হলো এই অধ্যাদেশ জারি করার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে নির্দেশ অনুযায়ী আগামী ২০২০ সালের মধ্যে শর্ত পূরণ করবে। তাহলে নতুন কমিটিতে ১২ জন নারী সদস্য যুক্ত করতে হবে। তখন নারী সদস্যের সংখ্যা দাঁড়াবে ২৭-এ। আগামী দুবছরের মধ্যে আদৌ কি এই শর্ত পূরণ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০২০ সালের মধ্যে একটি কাউন্সিল অধিবেশন করার সুযোগ পাবে।
রাজনীতি করার প্রক্রিয়াটি নারীর জন্য মসৃণ নয়। নারীর চারপাশ কখনও চায় না নারীরা রাজনীতিতে আসুক। তারপরও প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে তবে না নারীরা রাজনীতিতে রাখে পা। পা রাখলেও টিকে থাকতে পারে না। যারা টিকে থাকে তাদের কত ঝড়-ঝাপটা সহ্য করতে হয় কেবল তারাই জানে। রাজনীতির মূল দায়িত্বে জননেত্রী শেখ হাসিনা থাকায় নারীর সুভাগ্যের চাকাটি গড়িয়ে যাচ্ছে সম্মুখ পানে। তবে পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে সংস্কার আনতে হবে। বদলাতে হবে আচার-আচরণে কার্যকারিতার চিন্তা-চেতনা। রাজনৈতিক নারী কর্মীদের জন্য সুসংবাদ হলো-নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষে রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণী কমিটির সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি উদার হয়েছে। আওয়ামী লীগের ৬৪টি জেলা, ১২টি মহানগর সর্বমোট ৭৮টি সংগঠনিক জেলা কমিটির ৭১ সদস্যের কমিটিতে মহিলা সম্পাদক পদ ছাড়াও অনেক পদে নারীরা রয়েছেন। কিন্তু সাংগঠনিক জেলা কমিটিতে নারী সদস্যদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। ৪৯০টি উপজেলা, ৩২৩টি পৌরসভা, ৪৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন কমিটি রয়েছে। রয়েছে ইউনিয়নের ওয়ার্ড ও পৌরসভা কমিটি। এসব কমিটিতে যদি শর্ত মোতাবেক পদে নারীকে জায়গা করে দেওয়া হতো, তাহলে বিপুল সংখ্যক নারী রাজনীতি করার সুযোগ পেত। কিন্তু না বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বিপুল পরিমাণ নারী রাজনৈতিক কর্মীকে নানা অজুহাত দেখিয়ে সরিয়ে রাখা হয়। এর পিছনে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নারী বলেই হয়তো অথবা সত্যিকার অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন বিকাশের লক্ষ্যে সব সময় নারীদের রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। এ কারণেই ধারাবাহিকভাবে শুধু কেন্দ্র নয়, তৃণমূল পর্যায়েও বিভিন্ন কমিটিতে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সূচনালগ্নে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদে ১০টি সংরক্ষিত নারী আসনের পদ সৃষ্টি করে দিয়ে নারীকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এই আসন সংখ্যা দশম জাতীয় সংসদে ৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। চলমান দশম সংসদে বিচক্ষণতা ও সফলতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের বর্তমান নারী সমাজ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের পরিবর্তে সরাসরি নির্বাচন দাবি করছে। নানা অজুহাত তুলে কেউ কেউ সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করছে। অথচ সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ইত্যাদি পর্যায়ে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেই নারীকে নিজেদের নেতৃত্বের প্রতিফলন ঘটাতে হয়। তাহলে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের অসুবিধাটা কোথায়? নারীরা আশাবাদ ব্যক্ত করছে এই আসনে সরাসরি নির্বাচন হলে যোগ্য ও প্রকৃত নারী রাজনৈতিক কর্মী জাতীয় সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাবে। ব্যক্তি পরিচয়ে অযোগ্য নারীরা পেছন দরজা দিয়ে জাতীয় নীতি-নির্ধারণের পবিত্র জায়গায় যেতে পারবে না। তৃণমূল পর্যায়ের ও রাজপথের নারী রাজনৈতিক কর্মীদের কদর বাড়বে। নারীরা রাজনীতিকে সেবা ও পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে। আসুন আমরা নারীদের প্রতি আন্তরিক হই। নারী নেতৃত্বকে স্বাগতম জানাই ও নারীকে রাজনীতি করার ক্ষেত্র তৈরি করে দেই। বলি-নারী তুমি এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে। অধ্যক্ষ গেলিসান আরা বেগম

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

9 − two =