বাস থামার ১২১টি স্থান চিহ্নিত হয়েছে তবুও রাজধানীর পুরোটাই বাস স্টপেজ

0
851

নির্দিষ্ট স্থানে না থামিয়ে চলতে চলতে যেখানে-সেখানে বাসে যাত্রী ওঠানো-নামানো হয়। চলন্ত বাসে ছুটতে ছুটতে উঠতে গিয়ে যাত্রীদের প্রাণহানি, অঙ্গহানি হচ্ছে। চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে চাকায় পিষ্ট হওয়ার ঘটনাও নতুন নয়। এমন নৈরাজ্য বন্ধে চার দিন আগে পুলিশ কিছু নির্দেশনা জারি করেছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হয়নি এখনো।

এ কারণে বাসের চালকদের নির্দেশনা দেওয়ার কাজও হয়নি। ঢাকা শহরে ১৮ বছর আগে ২৯৮টি বাস থামার স্থান চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারাবাহিক তদারকির অভাব এবং পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের দাপটে চিহ্নিত স্থানগুলো কাজে আসেনি। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর এবার ঢাকা মহানগর পুলিশ বাস থামার ১২১টি স্থান চিহ্নিত করা শুরু করেছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশিষ্টজনরাও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছেন আজ শনিবার। গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে মাসব্যাপী ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘রাজধানীতে বাস থামানোর ১২১টি স্থান নির্ধারণ করেছি, সেগুলোতে বোর্ড লাগানো হচ্ছে। বাস স্টপেজ ছাড়া কোথাও বাসের দরজা খুলবে না। যাত্রীরাও স্টপেজ ছাড়া অন্যত্র নামতে পারবে না।’ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে শুধু পরিবহন মালিক ও চালকদের অবহিত করলেই হবে না। চিহ্নিত বাস স্টপেজের অবস্থান কোথায় হবে তা নিয়ে স্থানীয় ট্রাফিক পুলিশ স্থানীয় যাত্রীদের নিয়ে কর্মসূচি নিতে পারে। বাস স্টপেজে যাত্রী তোলা ও নামানোর জন্য বাস মালিকদেরও চালকদের নিয়ে নিয়মিত উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি নিতে হবে।

পুরো শহরই বাস স্টপেজ : গত কয়েক দিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বাস নির্দিষ্ট স্থানে না থামিয়ে সড়ক দখল করে যাত্রী তোলা হচ্ছে। এতে যেমন যানজট হচ্ছে, তেমনি সড়কে বিশৃঙ্খলাও বাড়ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে মামলাও করছে। তবে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। গতকাল শুক্রবার সকালে শাহবাগ মোড়ে দেখা যায়, চারটি সড়কের আটটি লেন এক হয়েছে মোড়ে। শাহবাগ মোড় থেকে উত্তরে এগোলে পাশেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল। এখানে বাস থামার স্থান রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ ট্রাফিক পুলিশ সেখানে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। বাস থামা শুরু ও শেষের অংশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুপুর আড়াইটায় এখানে ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে দেখা গেল, চিহ্নিত করা অংশে বাস থামানো হচ্ছে না। মোড়ে আসার আগে থেকেই যাত্রীদের তোলা হচ্ছে, নামানো হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুরমুখী শিকড় পরিবহনের কর্মী জালাল মিয়া বললেন, ‘যাত্রীরা আগেই উইঠ্যা পড়ে।’ তাঁর মতে, যাত্রী এত বেশি থাকে যে বাস নির্দিষ্ট স্থানে থামালে যাত্রী তোলার পর গেটও বন্ধ করা যায় না। অথচ পুলিশ বলেছে দরজা বন্ধ রেখে বাস চালাতে। বিকেলে কাজীপাড়া থেকে তালতলা, আগারগাঁও, মহাখালী, গুলশান-১, বাড্ডা হয়ে কুড়িল রুটে বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে চলতে চলতে দেখা গেল, প্রায় ১৯ কিলোমিটার এই পথে মাত্র দুটি স্থানে বাস থামার স্থান নির্দেশকারী সাইনবোর্ড আছে। সেগুলোতে বাস থামছে না। বিহঙ্গ পরিবহনের ওই বাসে উঠতে হলো চলন্ত অবস্থায় কাজীপাড়া ওভারব্রিজের নিচ থেকে। কাজীপাড়ার পর দেখা গেল, শেওড়াপাড়ার হাজী আশ্রাফ আলী হাই স্কুলের গলির সামনে আসার আগেই চলন্ত অবস্থায় যাত্রী তোলা হচ্ছে। সেখানে বাস স্টপেজ লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়েনি। এভাবে তালতলা, আগারগাঁও, মহাখালী আমতলা, ওয়্যারলেস, টিবি গেট, গুলশান-১-এর গোলচত্বরের এপারে ও ওপারে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। গুলশান-১ গোলচত্বর পার হওয়ার পর ও গুলশান লেকের পাশে গুদারাঘাটের কাছে আসার আগে বাঁয়ে চোখে পড়ল ‘বাস থামিবে’ লেখা সাদাকালো ছোট নির্দেশক। কিন্তু সেটা রয়েছে গাছপালার আড়ালে। চলন্ত বাস থামানো হয় গুদারাঘাটে, যেখানে বাস থামার কোনো নির্দেশক নেই। বাসচালকের সহকারী মো. ইমরান জানান, বাস থামানোর স্থানগুলো কোথায় সেটা তাঁরা অন্যের দেখাদেখি শিখেছেন। অন্য বাসচালকরা যেভাবে যেখানে থামায়, সেখানে তাঁরাও থামান। তবে যাত্রীরা হাত ইশারা করলে রাস্তা থেকে তাদের তোলেন। বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে যেতে যেতে দেখা গেল, বাড্ডা লিংক রোডে সৈনিক ভবনের সামনে বাসে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিল ১০-১২ জন। মোড়ের পাশে এখান থেকে বাসে ওঠা বিপজ্জনক। এর পরও বাস আসতে না আসতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে অপেক্ষমাণ লোকজন। উত্তর বাড্ডা হাজী মার্কেটের সামনে বাসটি একটু থামিয়ে ছয়জন যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হয়। তখন প্রায় দৌড়েই বাসে ওঠে কয়েকজন। তাদের একজন আবদুল হালিম বলেন, ‘বাস কোথায় থামবে, তা আমরা জানি না। চলন্ত বাসের পেছনে পেছনে দৌড়ে উঠতে হয়।’সবচেয়ে বেশি বাস চলাচল করে মিরপুর প্রান্ত থেকে। মিরপুরে ১০ নম্বর গোলচত্বরে কিংবা কালশীতে ‘বাস থামার স্থান’ লেখা সাইনবোর্ড আছে। সেসব স্থানে গতকাল বাস থামতে দেখা যায়নি। কালশীতে আকিক পরিবহনের যাত্রী নুর আলী পরিস্থিতি দেখে বললেন, ‘পুরো ঢাকাই যেন টার্মিনাল। রাতে তো মিরপুর, গাবতলীতে সারি সারি বাসের দখলে থাকে সড়ক।

নতুন উদ্যোগ : বাংলামোটরের দিক থেকে শাহবাগ মোড় হয়ে মৎস্য ভবনের দিকে যেতে বাস সাধারণত বারডেম হাসপাতালের সামনে থামে। সেখানেই দীর্ঘদিন ধরে লোকজন বাস স্টপেজ হিসেবে চিনে আসছে। কিন্তু নিরাপত্তা ও পরিবহনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সেই স্পপেজটি করা হয়েছে ঢাকা ক্লাবের কাছাকাছি। এখন থেকে বাসকে সেখানে গিয়ে থামতে হবে। শুধু সেখানেই নয়, রাজধানীতে এভাবে ১২১টি স্টপেজ করা হবে। এর মধ্যে শুধু ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগেই রয়েছে ৪২টি স্টপেজ। ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার এস এম মুরাদ আলী বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এরই মধ্যে বাস স্টপেজ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে এখন স্ট্যান্ড লাগানো হয়েছে। পরে সাইনবোর্ড লাগানো হবে। সিটি করপোরেশন যাত্রীছাউনি তৈরি করছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা  বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। রাস্তার সব জায়গায় নজরদারি করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বাসচালক, হেলপার, যাত্রীসহ সবারই সচেতনতা দরকার।’ ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম  বলেন, ‘প্রতিটি এলাকায় পুলিশ রয়েছে, তারাই বাসচালক, হেলপার, যাত্রীদের জানাচ্ছে বাস স্টপেজের বিষয়ে। এ ছাড়া লিফলেট বিতরণ করা হবে।’ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতউল্লাহ  বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ যে বাস স্টপেজ চিহ্নিত করছে, এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে এখনো কোনো কথা বলেনি। আমরা বাস কাউন্টার স্থাপনের জন্য এক সপ্তাহ আগে দুই সিটি করপোরেশনে চিঠি দিয়েছি। তারও কোনো সাড়া পাচ্ছি না।’

নামছেন বিশিষ্টজনরা : কিছুদিন আগে পরিবহনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলার দুজন শিক্ষার্থীর প্রাণহানির পর ওই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সভা করেছে। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সময় বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত মাসে ১৭টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে এবার রাস্তায় নামছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। আজ দুপুর ১২টায় রাজধানীর শাহবাগে নামবেন তাঁরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শিক্ষক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা, জাতীয় দলের ক্রিকেটার, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ সমাজের বিশিষ্টজনরা অংশ নেবেন তাতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি ট্রাফিক (দক্ষিণ) এস এম মুরাদ আলী বলেন, ‘ট্রাফিক সচেতনতার এ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন। তাঁরা ট্রাফিক সচেতনতার বিষয়ে বক্তব্য দেবেন।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × 1 =