শতাধিক মামলায় গ্রেফতার এসএ গ্রুপের এমডি শাহাবুদ্দিন

0
761

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের হাতে গ্রেফতার হওয়া চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো. শাহাবুদ্দিন আলম দেশের অন্তত দুই ডজন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে— ব্যাংকগুলো তেমন কোনো বাছবিচার ছাড়াই অনেকটা জামানতবিহীন ঋণ দিয়েছে এ ব্যবসায়ীকে। ঋণের অর্থে তিনি গড়ে তুলেছেন দেড় ডজন প্রতিষ্ঠান।

প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণের ভারে নিমজ্জিত এসএ গ্রুপের এ কর্ণধারকে অবশেষে বুধবার ঢাকার গুলশান থেকে ঋণ-খেলাপির দায়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদালতে ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা শতাধিক মামলায় গ্রেফতার করা হয়। তিনি নিজেও একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক। চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত এলাকার খুলশীতে চার একর জমিতে শাহাবুদ্দিনের বর্তমান বাড়ি। তার আত্মীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, খুলশীতে চার একর জমিতে অবস্থিত এ প্রাসাদের মূল্য কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা। ইপিজেড এলাকায় রয়েছে তাদের পুরনো বাড়ি। বছর তিনেক আগে শাহাবুদ্দিন আলমের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় চট্টগ্রামের আর এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শওকত আলমের একমাত্র মেয়ের। জাঁকজমকপূর্ণ সেই বিয়েতে দুই পরিবার শত কোটি টাকা ব্যয় করে বলে দেশব্যাপী আলোচিত হয়। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, শাহাবুদ্দিন আলমের এসএ গ্রুপের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ‘সামান্নাজ ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড’ ঋণের দায়ে নিমজ্জিত হয়ে কোম্পানিটি অবসায়ন বা বিলুপ্তির জন্য আদালতে আবেদন করেন তিনি। তবে এর বিরুদ্ধে আপিল করেছে ঋণদাতা অধিকাংশ ব্যাংক। কারণ, প্রতিষ্ঠানটিতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকের বড় ধরনের ত্রুটি ছিল। নামমাত্র জামানত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামানত ছাড়াই শাহাবুদ্দিন আলম ঋণ পেয়েছেন। ঋণের এ অর্থ আদায়ে দিশাহারা হয়ে আদালতের আশ্রয় নেন ব্যাংকের নির্বাহীরা। একটি ব্যাংকের নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শাহাবুদ্দিন আলমের মতো ধুরন্ধর গ্রাহক খুব কমই রয়েছে। নানা কৌশলে তিনি ব্যাংকারদের মুগ্ধ করেছেন। এতেই শত শত কোটি টাকার ঋণ তার পকেটে ঢুকে পড়ে। জানা গেছে, গ্রুপটির কাছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ঋণের পরিমাণ ৪৮১ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ আগ্রাবাদ শাখায় ৪২৩ কোটি ও ব্যাংক এশিয়া সিডিএ শাখায় ৩৩৮ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়ার বড় অঙ্কের এ ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে নামমাত্র। ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ঋণের পরিমাণ ২২১ কোটি টাকা। এ ছাড়া গ্রুপটির কাছে জনতা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ঋণের পরিমাণ ২০০ কোটি, রূপালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৫১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি শাখার ১১৮ কোটি ও কৃষি ব্যাংক ষোলশহর শাখার ১০০ কোটি টাকা। পূবালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখারও ২৮৮ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে এসএ গ্রুপের কাছে। পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া গ্রুপটিকে কেন ঋণ দেওয়া হয়েছে— তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি কোনো ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে। এসএ গ্রুপের কাছে পূবালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় গ্রুপটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে জানিয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, এসএ গ্রুপের কাছে ব্যাংকের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ২০-২৫ কোটি টাকার সম্পদ। এ জন্য আদালতে কোম্পানি অবসায়নের আবেদনের বিরুদ্ধে পূবালী ব্যাংকের পক্ষে আপিল করা হয়েছে। আদালতের আদেশ পূবালী ব্যাংকের পক্ষে এসেছে। এদিকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা এসএ গ্রুপকে ঋণ দিয়েছে সাড়ে ৫৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া গ্রুপটিতে উত্তরা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ঋণ রয়েছে ৫২ কোটি, প্রাইম লিজিংয়ের ৩৬ কোটি ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৪ কোটি টাকা। ঢাকা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখারও ২৪৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। গ্রুপটির কাছে ঢাকা ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২৫০ কোটি টাকা আদায়ে এরই মধ্যে মামলা করা হয়েছে। এসএ গ্রুপ কোম্পানি অবসায়নের যে আবেদন জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধেও আপিল করা হয়েছে। আপিল আদেশ ব্যাংকের পক্ষে এসেছে। কোম্পানিটির যে পরিমাণ ঋণ আছে, সে অনুপাতে সম্পদ নেই বললেই চলে। অবসায়ন হলে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবে। এসএ গ্রুপের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে কয়েক বছর ধরেই আইনি প্রক্রিয়া চালাচ্ছে ঋণদাতা অধিকাংশ ব্যাংক। এর মধ্যে ২০১৫ সালে কয়েকটি ব্যাংক থেকে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধাও গ্রহণ করে গ্রুপটি। তবে নির্দিষ্ট সময় পরও প্রতিষ্ঠানটি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি। এতে আবারও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো আদালতের দ্বারস্থ হয়। ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পাওয়া ১১ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসএ গ্রুপও রয়েছে। ওই সময় এসএ গ্রুপের এসএ অয়েল রিফাইনারি ও সামান্নাজের পক্ষে ৯২৮ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে ছয়টি ব্যাংক। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৯৯ কোটি টাকা পুনর্গঠন করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে কিস্তি পরিশোধের কথা থাকলেও আর কোনো অর্থই পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে বেশির ভাগ ব্যাংক আবারও আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। অনেক ব্যাংকের কাছে ঋণের বিপরীতে কোনো বন্ধকী সম্পত্তিও নেই বলে জানা গেছে। ফলে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ব্যাংকগুলো।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × one =