আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হয়ে গেলেন খালেদা জিয়া

0
536

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেছেন হাইকোর্ট। অপর দুই আসামি সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।

 

এ রায়ের পর মামলাটিতে খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। একই সঙ্গে এ রায়ের মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হয়ে গেলেন খালেদা জিয়া। গতকাল রায় ঘোষণার পর প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ব্যানারে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আজ বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ১টা পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতেই এ কর্মসূচি বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীন। তিনি বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান। খালেদা জিয়ার সাজা বাড়ানোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, এ মামলায় খালেদা জিয়া মুখ্য আসামি। নিম্ন আদালত তাঁকে সাজা দিয়েছেন পাঁচ বছর। আর সহযোগীদের দিয়েছেন ১০ বছর। আর এ কারণেই হয়তো হাইকোর্ট মুখ্য আসামি খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, এই রায় ইঙ্গিত বহন করে যে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে কেউ অন্যায় করলে সে আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। তিনি বলেন, এ রায় রাজনীতিবিদদের জন্য একটি মেসেজ।

নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে গেলেন : নির্বাচনে অযোগ্যতা প্রসঙ্গে সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘একজন অযোগ্য হবেন যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’ এ হিসাবে হাইকোর্টের রায়ের পর আপাতদৃষ্টিতে খালেদা জিয়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হয়ে গেলেন। তবে রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া যদি আপিল করেন এবং যদি সাজা বাতিল হয় তবে তিনি প্রার্থী হতে পারবেন। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও বলেছেন, যতক্ষণ সাজা বাতিল না হয়, ততক্ষণ তিনি অযোগ্য। সাজা স্থগিত যদি হয়, আপাতত জেল খাটা থেকে হয়তো তিনি অব্যাহতি পেতে পারেন, কিন্তু নির্বাচন করতে পারবেন না। একই অভিমত দেন দুদকের আইজীবী খুরশীদ আলম খান এবং অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। গতকালের রায়ের পর আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী রায়ের কপি পাওয়ার এক মাসের মধ্যে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। শুধু কারাবন্দিরাই আপিল করতে পারবেন। এ মামলায় খালেদা জিয়া, কাজী সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন আহমেদ কারাগারে বন্দি। গতকাল থেকে এই দিন গণনা শুরু হলেও রায়ের কপি যতদিন না পাচ্ছে ততদিন ওই ৩০ কার্যদিবস থেকে বাদ যাবে। আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রায়ের কপি কবে নাগাদ পাওয়া যাবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। আবার রায়ের কপি পাওয়ার পর খালেদা জিয়া আপিল করলেও সেই আপিল নিষ্পত্তির সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। এ দেশে সচরাচর এ ধরনের দুর্নীতি মামলায় আপিল নিষ্পত্তি হতে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরও পেরিয়ে যায়। অথচ সংবিধান অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই। এই হিসেব অনুয়ায়ী, খালেদা জিয়া আপিল করলেও মাত্র তিন মাসে সেই আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই সংশ্লিষ্টদের মত। কাজেই গতকালের রায়ের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছেন না, তা এক রকম নিশ্চিত হয়ে গেল। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এ গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের জেল হয়। এরপর খালেদা জিয়ার সাজা বাড়াতে দুদক আবেদন করে। এ আবেদন মঞ্জুর এবং নিম্ন আদালতের সাজার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া, কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের করা আপিল খারিজ করে গতকাল রায় দেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এ মামলা নিষ্পত্তি করতে আপিল বিভাগের নির্দেশ থাকায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই রায় ঘোষণা করা হলো। এ মামলায় নিম্ন আদালতে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মোমিনুর রহমান পলাতক থাকায় তাঁরা আপিল করার সুযোগ পাননি। এ কারণে তাঁদের সাজা বহাল রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। গতকাল রায় ঘোষণার আগে এজলাসে বসেই বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম বলেন, ‘আমরা শুধু আদেশের অংশ পাঠ করব।’ এরপর আদালত রায় ঘোষণা করে বলেন, ‘আসামিপক্ষে করা তিনটি আপিল খারিজ করা হলো। খালেদা জিয়ার সাজা বাড়াতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করা হলো। খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করা হলো।’ মাত্র এক মিনিটের মধ্যে রায় ঘোষণা করে বিচারপতিদ্বয় এজলাস থেকে নেমে যান। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা খুশি। কারণ দুদক সাজা বাড়ানোর আবেদন করেছিল।’ রায় ঘোষণার সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও মোমতাজউদ্দিন ফকির, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু, একরামুল হক টুটুলসহ রাষ্ট্রপক্ষের শতাধিক আইন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম, অ্যাডভোকেট আজহার উল্লাহ ভুইয়াসহ সরকার সমর্থক আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। দুদকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন খুরশীদ আলম খান, মোশাররফ হোসেন কাজল। আদালত কক্ষে আসামিপক্ষের জন্য রক্ষিত আইনজীবীদের বেঞ্চ (সামনের সারি) ফাঁকা থাকায় সেখানে বসেন আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ। বিচারপতিরা এজলাসে বসে এ দৃশ্য দেখার পর আদালত বলেন, ‘আপনারা ডিফেন্সের (আসামিপক্ষ) বেঞ্চে বসেছেন কেন?’ জবাবে শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘এটা তো আইনজীবীদের বসার স্থান।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘এটা ডিফেন্সের জন্য। ডিফেন্সের আইনজীবীদের বসতে দিন।’ এরপর শ ম রেজাউল করিম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল উঠে অন্য বেঞ্চে বসেন। এরপর আসামি শরফুদ্দিন আহমেদের পক্ষে একজন জুনিয়র আইনজীবী সেখানে বসেন। এরপর রায় ঘোষণা করেন আদালত।

অনাস্থার আবেদন প্রত্যাখ্যাত : গতকাল সকাল সোয়া ৯টায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগে একটি লিখিত আবেদন নিয়ে যান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। সে আবেদনে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চের প্রতি অনাস্থা জানানো হয়। খালেদা জিয়ার আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী আবেদনটি উপস্থাপন করতে গেলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এভাবে হবে না। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দাখিল করুন।’  জবাবে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপনারা বলেছিলেন ৩০ অক্টোবরের মধ্যে আমাদের আবেদন (অর্থের উৎস জানতে একজন সাক্ষীর অধিকতর সাক্ষ্যগ্রহণ) নিষ্পত্তি করতে। কিন্তু হাইকোর্ট আমাদের বক্তব্য না শুনেই একতরফাভাবে রায়ের দিন নির্ধারণ করেছেন। এ অবস্থায় আমাদের বিশ্বাস হয়েছে খালেদা জিয়া ন্যায়বিচার পাবেন না।’ তিনি আবেদনটি গ্রহণের আরজি জানিয়ে বলেন, সরাসরি আপিল বিভাগে দাখিল করার অনেক নজির রয়েছে। এর পরও প্রধান বিচারপতি আবেদন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।

বর্জনের ঘোষণা : রায় ঘোষণার পরপরই বিএনপিপন্থী কিছু আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট ভবনে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাঁরা রায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা জরুরি বৈঠকে আজ সকাল ৯টা থেকে বিকেল ১টা পর্যন্ত আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। দুপুরে সমিতি ভবনের দক্ষিণ হলে সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচিটি ঘোষণা করেন সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য এবং এ রকম একটা বেআইনি রায় দেওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে আদালত বর্জনের কর্মসূচি দেওয়া হলো। অন্যান্য দিন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও গতকাল এ আদালত কক্ষে ঢুকতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সাংবাদিকরাও বাধার মুখে পড়লে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এসে তাঁদের ঢোকার ব্যবস্থা করেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 × 4 =