দুর্ধর্ষ দুর্নীতিবাজদের হাতে জিম্মি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস

0
637

অবি ডেস্কঃ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দুর্নীতিবাজ চক্র দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এই চক্রের সদস্যরা (অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী) আমদানিকারকদের নানা কৌশলে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, এই শুল্ক স্টেশনে পোস্টিং পেয়েই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার নেশায় মেতে ওঠেন। আমদানিকারকদের গলা কাটতে তারা চাঁদাবাজি ও ঘুষ আদায়ের নিত্যনতুন কৌশল বের করেন। শতভাগ কায়িক পরীক্ষা হওয়ার পরও পণ্য পুনঃপরীক্ষার নামে চলছে হয়রানি। এসব বিষয় নিয়ে যৌক্তিক বক্তব্য তুলে ধরা হলে আমদানিকারকের প্রতিনিধিদের রীতিমতো অপমান-অপদস্ত করা হয়। আইনের নানা ফাঁক-ফোকর বের করে কখনও কখনও আমদানিকারকদের ফাঁসিয়ে দেয়া হয়।

 

তাদের আরও অভিযোগ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে পণ্য চালান ছাড় করে দেয়া হয়। এতে কাস্টমসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ও গাড়িবাড়ির মালিক বনে যান। টাকা আদায়ের জন্য বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত থাকে তাদের দালাল চক্র। কাস্টমসে ফাইল স্বাক্ষর হলেও এই চক্রের মাধ্যমে রাতের আঁধারে বাসাবাড়ি কিংবা রেস্টুরেন্টেই হয় ঘুষের লেনদেন। আয়কর বিভাগ কিংবা দুদক থেকে বাঁচতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের স্ত্রী-পুত্র কিংবা স্বজনদের নামেই সম্পদের পাহাড় গড়েন।

কাস্টমসে দুর্নীতির সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে গত ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন ঘুষের ছয় লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হন দুদকের হাতে। কাস্টম হাউসের নিচতলায় নিজ কক্ষেই এই কর্মকর্তার আলমারি থেকে ঘুষের ছয় লাখ টাকা উদ্ধার করে দুদকের অভিযান টিম। হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে।

এ ছাড়া গত ৯ জানুয়ারি কাস্টম হাউসের অপর এক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন হাজারী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দীর্ঘ তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে এই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার স্ত্রী হালিমা বেগমের নামে পাওয়া গেছে তিন কোটি দুই লাখ ৩২ হাজার টাকার সম্পদ। ডবলমুরিং থানায় এ মামলাটি দায়ের করেন দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সামশুল আলম।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে দুর্নীতি ও হয়রানি প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, আমরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তবে একপক্ষের দ্বারা দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। আমদানিকারক বা ব্যবসায়ীদের যেমন ট্রান্সপারেন্ট হতে হবে তেমনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ট্রান্সপারেন্ট হতে হবে। দুই পক্ষের মধ্যে ট্রান্সপারেন্সি থাকলে তবেই দুর্নীতি বন্ধ হবে।

দুদকের মহা-পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী বেপরোয়া দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে আমাদের কাছে নানাভাবে অভিযোগ আসছে। তারা নানা কৌশলে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে অর্থ আদায় করেন। রাতারাতি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক বনছেন। এটা সুশাসনের পথে অন্তরায়। আমরা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ওপর নজরদারি শুরু করেছি। চিহ্নিত কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছি। এরই মধ্যে এক কাস্টমস কর্মকর্তাকে হাতেনাতে ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের সর্বনিু পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ঘুষের লেনদেন হয় বলে অভিযোগ আছে। আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। আরও বড় অভিযান পরিচালনা করা হবে।

আমদানিকারকদের প্রতিনিধি, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানি ও রফতানি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে কাস্টম হাউসে দুর্নীতি আরও জেঁকে বসেছে। এ জন্য তারা রয়েছেন উদ্বেগের মধ্যে।

তারা বলছেন, বর্তমান সরকার শিল্প ও বাণিজ্যবান্ধব নীতিমালার পথে হাঁটলেও কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তারা হাঁটছেন উল্টো পথে। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প ধ্বংস করার চক্রান্তের অংশ হিসেবেই একটি চক্র হয়রানির পথ বেছে নিয়েছে। ব্যবসায়ী ও ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এই চক্রটি নানা কৌশলে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন সময়ে কাস্টমসে এই অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন সংশ্লিষ্টরা। অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধে দুর্নীতিবাজদের চট্টগ্রাম শুল্ক স্টেশন থেকে সরিয়ে নেয়ার দাবিতেও বিভিন্ন সময় আন্দোলন হয়। আন্দোলনের কারণে নিতান্ত চাপের মুখে পড়লে অভিযুক্তদের কাউকে বদলি করা হয়। এটিই তাদের শাস্তি। ফলে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হয় না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্যের ঘোষণা সঠিক থাকা সত্ত্বেও পণ্য শণাক্তকরণ এইচএস (হরমোনাইজড সিস্টেম) কোডের মতো একটি টেকনিক্যাল ভুলের কারণে মোংলা, বেনাপোলসহ দেশের অন্য কোনো স্টেশনে জরিমানা করা হয় না। অথচ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিনিয়ত এইচএস কোডের ভুলের কারণে জরিমানা করা হচ্ছে। অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। যে কারণে জমছে মামলার পাহাড়। আমদানি পণ্য এআইআর (অডিট ইনভেস্টিগেশন রিচার্জ ) ও শুল্ক গোয়েন্দার মাধ্যমে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর পুনঃপরীক্ষার নামেও হয়রানি করা হয়। শুল্ককর পরিশোধের পর পণ্য খালাসকালে আনস্টাফিং বিভাগ পণ্য চালান তদারকির পরিবর্তে শতভাগ কায়িক পরীক্ষণের নামে সময় ও অর্থের শ্রাদ্ধ করে।

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের অনেকের অভিযোগ, পণ্যের এইচএস কোড নির্ধারণ, শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণসহ আইনগত বিষয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা তাদের আমদানিকারকের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত যুক্তি উত্থাপনের আইনগত অধিকার সংরক্ষণ করেন। কিন্তু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত কাস্টমস কর্মকর্তারা ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধিদের কোনো যুক্তিই গ্রাহ্য করতে চান না।

এমনকি তাদের যুক্তিসঙ্গত দাবি জানাতে গেলে পিয়ন-দারোয়ান পর্যন্ত নানা কৌশলে আমদানিকারক, তাদের প্রতিনিধি বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অপমান-অপদস্ত করেন। শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ একচেটিয়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। অপ্রয়োজনীয় নথি খোলা হয়। সিদ্ধান্ত প্রদানে বিলম্বের কারণে পণ্য চালানের ডেমারেজ বৃদ্ধি হয়।

এছাড়া ‘রেড রি-রুট ও লক ওপেন-এর নামেও চাঁদাবাজি করেন অসাধু কর্মকর্তারা। কাস্টমসের এসি (সহকারী কমিশনার) পদমর্যাদার কর্মকর্তারা পণ্য চালানের শুল্কায়ন নিয়ে সংশয়-সন্দেহ পোষণ করলে মূল্যতালিকায় রেড মার্ক’ দিয়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যটির ফাইল আটকে রাখেন। পণ্য পুনঃশুল্কায়নের পর সেটি ছাড় বা ‘রেড-রি রুট করা হয়। অভিযোগ আছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘুষ আদায়ের জন্যই এটি করে থাকেন অসাধু কর্মকর্তারা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

12 − 9 =