পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য থামানোর সাধ্য যেন কারও নেই

0
856

পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য থামানোর সাধ্য যেন কারও নেই। রাজধানীর শতাধিক পয়েন্টে এখন অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে চাঁদাবাজি। একশ্রেণির পরিবহন শ্রমিক, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে চাঁদাবাজ চক্র।

 

তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছেন যানবাহন চালক, মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। সন্ত্রাসীরা রাখঢাক না রেখে সরাসরি ‘চাঁদা’ তুললেও পরিবহন শ্রমিকরা চাঁদা নেন শ্রমিক কল্যাণের নামে। রাস্তা ক্লিয়ার ফি, ঘাট ও টার্মিনাল সিরিয়াল, পার্কিং ফি নামের চাঁদাবাজি পরিবহন খাতের নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দিনরাত চাঁদা আদায়ের কাজটি করে থাকে ‘লাঠি বাহিনী’, ‘যানজট বাহিনী’ ও ‘লাইন বাহিনী’। চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি হয়ে থাকছে অসহায় ২০ লাখ পরিবহন শ্রমিক। তারা জানান, চাকা ঘুরলেই চলে টাকার ছড়াছড়ি। টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের হওয়ার আগেই একেকটি গাড়িকে জিপি নামক চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। এটি আদায় করে লাঠি বাহিনী। টার্মিনাল মুখেই যানজট বাহিনীকে দিতে হয় ২০ টাকা ‘কাঙালি চাঁদা’। এরপর লাইনম্যানের পালা, এক্ষেত্রে দিতে হয় ৩০ টাকা। এর বাইরে রয়েছে টার্মিনালের টোল। শুরু হয় পরিবহন-সংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নামে ৫০ টাকা, মালিক সমিতি ৮০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ৪০ টাকা, টার্মিনাল কমিটি ২০ টাকা, কলার বয় ব্যবহার বাবদ ২০ টাকা, কেরানির ভাতা ২০ টাকা, মালিক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নামে ৫০ টাকা এবং একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের নামে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নানা খাতের চাঁদার ধকল। একইভাবে গাবতলী থেকে যাতায়াত করা ১৫১টি রুটের কয়েক হাজার যানবাহনকেও অভিন্ন চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। একই স্টাইলে চাঁদাবাজি চলে মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালেও। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সায়েদাবাদ থেকে দেশের পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের ৮৭টি রুটে চলাচলরত সাড়ে তিন সহস্রাধিক যানবাহন থেকে প্রতিদিন ফ্রি স্টাইলে চলছে চাঁদাবাজি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ ৩২টি রুটেই চলাচল করে ১২০০ বাস-মিনিবাস। এ ছাড়া রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল, মহাখালী, উত্তরা, গাজীপুর, টঙ্গী, কালীগঞ্জ, শ্রীপুর, কাপাসিয়াসহ শহর ও শহরতলির অন্যান্য রুটে সহস্র্রাধিক বাস-মিনিবাসের চলাচল রয়েছে। বাস-মিনিবাসের চালক ও শ্রমিকরা জানান, চাঁদা না দিয়ে কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে বাইরে বের করার সাধ্য কারও নেই। চাঁদা নিয়ে টুঁশব্দ করলে নির্যাতনসহ টার্মিনাল ছাড়া হতে হয়। দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে এবং লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। বৈধ-অবৈধ ৯৩২ সংগঠনের চাঁদাবাজি: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা দেশে পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের সংগঠন রয়েছে ৯৩২টি। এর মধ্যে ৬৮৬টিই অবৈধ। এসব অবৈধ সংগঠনের কারণেই চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। সংশ্লিষ্ট কমিটি ও শ্রমিক-মালিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অবৈধ সংগঠনগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলে চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়ে যাবে। ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে দৈনিক ১৫ থেকে ১৬ হাজার ও ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। টার্মিনালের যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, পরিবহন সেক্টরকে চাঁদাবাজিমুক্ত করার জরুরি প্রয়োজনবোধ করে সবাই, কিন্তু এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গ্রুপে গ্রুপে মারামারি, হাঙ্গামা, ভাঙচুর এমনকি সশস্ত্র সন্ত্রাসী অপতৎপরতায় হতাহতের ঘটনাও কম হয়নি। এসবের জের ধরে পরিবহন মালিকরা ইচ্ছামতো বাস ভাড়া ও ট্রাক-কনটেইনার ক্যারিয়ারের ভাড়া বাড়িয়ে তাদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিলেও সব ক্ষেত্রে যাত্রীদেরই সর্বোচ্চ পরিমাণ খেসারত দিতে হয়েছে। ট্রাক থেকেই দৈনিক কোটি টাকা: বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে পুলিশ। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, এর প্রতিবাদ করলে হয়রানি আরও বেড়ে যায়। দেশে প্রতিদিন ৯০ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল করে। এর কোনোটিই পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে চলতে পারে না। তিনি বলেন, সড়ক বা মহাসড়কে এই ট্রাক চলাচল করতে গিয়ে একেকটি স্পটে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা যেমন হাইওয়ে পুলিশ নেয়, তেমনি মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামেও আদায় করা হয়। তবে চাঁদাবাজি নিশ্চিত করতে গিয়ে যেসব প্রশাসনিক হয়রানি চালানো হয়, এতে ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঢাকার বাইরে আরও খারাপ অবস্থা: পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজিতে ঢাকার পরেই দ্বিতীয় স্থানটি দখল করে রেখেছে উত্তরাঞ্চলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত বগুড়া। ওই শহরের বুকের ওপর দিয়েই উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার যানবাহন চলাচল করে। বগুড়ার পরিবহন নেতাদের চাঁদা না দিয়ে এই অঞ্চলে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। রাতে এবং দিনে সমান হারে চাঁদা আদায় হয়। চাঁদার টাকা স্থানীয় পর্যায়ে ভাগাভাগির পর একটি বড় অংশ ঢাকায় মন্ত্রীর কাছেও চলে আসে বলে স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পরিবহন সেক্টরের দখল পাওয়া পরিবহন নেতারা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। বগুড়া শহরে চলাচলরত রিকশাভ্যান, ব্যাটারি রিকশা, সিএনজি, হিউম্যান হলার ও বাসচালকসহ সবাইকেই চাঁদা দিতে হয়। বগুড়া শহর এলাকায় সিএনজি রাস্তায় নামাতে গেলেই মালিক সমিতিকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয়। এরপর প্রতিদিন সমিতিকে ৫৫ টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া শহরের তিনমাথা, চারমাথা, তালোর, দত্তবাড়ি, মাটিডালি বিমান মোড়, কাহালু রোডসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ১০ থেকে ২০ টাকা হারেও চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নকে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে চালককে সমিতির কার্ড করে নিতে হয়। বগুড়ায় বিভিন্ন রুটে প্রায় ১০ হাজার সিএনজি চলাচল করে। এরপর প্রতিদিন কোনো কোনো পয়েন্টে ৬০ টাকা আবার কোনো কোনো পয়েন্টে ১০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। কাহালু রোডে প্রায় ২০০টি সিএনজি চলাচল করে বলে সিএনজি চালকরা জানিয়েছেন। শহরে প্রায় ৮০০ থেকে ১ হাজার মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার রেন্ট-এ-কার হিসেবে ভাড়ায় খাটে। পুলিশ এসব গাড়ি আটক করেও গাড়িপ্রতি ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে। উত্তরাঞ্চলের বিশাল শস্যভা ার থেকে সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পরিবহন করা হয়। এজন্য প্রতিদিন বগুড়া ছুঁয়ে হাজার হাজার ট্রাকের আসা-যাওয়া চলে। এসব ট্রাক থেকে প্রতিদিন ৩০০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয় বলে জানা গেছে। এ ছাড়া টার্মিনাল ট্যাক্স বাবদ ২৫০ এবং অন্যান্য খাত দেখিয়ে আরও ১০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এসব চাঁদার টাকার ভাগ থেকে পুলিশ বাদ যাচ্ছে না। পুলিশকে ম্যানেজ করেই সমিতিগুলো বছরের পর বছর ধরে চাঁদা আদায় করছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five + eleven =