কড়াইল ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প সরকারের ক্ষতি হাজার কোটি টাকা

0
588

অবি ডেস্কঃ অসামঞ্জস্যপূর্ণ চুক্তির ভিত্তিতে বনানীতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের উদ্যোগে বাস্তবায়ন হতে চলেছে কড়াইল ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প। এ চুক্তির কারণে প্রকল্পভুক্ত জমির মালিকানা বাবদ কোনো সাইনিং মানি দিতে হচ্ছে না ডেভেলপারকে। এ কারণে সরকারের ক্ষতি হতে চলেছে ৫২৪ কোটি টাকা। ফ্লোর স্পেসের ৬০ শতাংশই পাচ্ছেন ডেভেলপার। জমির মালিক অর্থাৎ সরকার পাচ্ছে মাত্র ৪০ শতাংশ ফ্লোর স্পেস। এ কারণে সরকারের লোকসান হবে ৪৬৩ কোটি টাকা।

 

গুলশান-বনানীতে কোনো ডেভেলপার জমির মালিককে এক কাঠা জমির বিপরীতে অন্তত ২০ লাখ টাকা সাইনিং মানি দেন। ফ্লোর ভাগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ থাকে ভূমি মালিকের, সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ থাকে ডেভেলপারের। এ ছাড়া এ ধরনের প্রকল্পের অপরিহার্য কিছু ক্ষেত্র, যেমন- সুইমিংপুল, কমিউনিটি সেন্টার, ফুলবাগান ইত্যাদির ব্যয়ও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ জন্য পৃথকভাবে মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এভাবে সরকারের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে পূর্ত বিভাগ অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান গুলশান লেকপাড়ে তৈরি করতে চলেছে চার হাজার ৬৬২টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এটি বাস্তবায়িত হলে সরকার প্রায় ১৫০ বিঘা জমির মালিকানা হারাতে পারে। তেমনি আর্থিক ক্ষতি হবে অন্তত হাজার কোটি টাকার।

এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সদ্য অবসর নেওয়া প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ‘বেশি কথা’ বলতে অনাগ্রহ দেখান। তিনি বলেন, সব ধরনের নিয়মকানুন মেনেই ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রণয়ন করা হয়েছে। তা ছাড়া গণপূর্ত অধিদপ্তরের কোনো প্রকল্প নিয়মের বাইরে করার সুযোগ নেই। সরকারের ক্ষতি হয় এমন কাজ গণপূর্ত করবে কেন? এ প্রকল্পে অনিয়ম বা কারও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ারও সুযোগ নেই। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।

একাধিক ডেভেলপার ও রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গুলশানে অন্তত ৬০ শতাংশ ফ্লোর স্পেস ভূমি মালিক পান। একটু বড় আয়তনের জমি হলে পার্সেন্টেজ আরও বাড়ে। এ ছাড়া সাইনিং মানি তো কাঠাপ্রতি অন্তত ২০ লাখ টাকা থাকেই। দেড়শ’ বিঘা জমি একসঙ্গে হলে সেখানে অত্যাধুনিক ও আকর্ষণীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে জমির মালিকের ফ্লোরের পার্সেন্টেজ ও সাইনিং মানি আরও বেশি হওয়ার কথা।

গুলশান লেকপাড়ে বনানীর কড়াইলে ৪৩ দশমিক ৩৮ একর (১৩০ দশমিক ১৪ বিঘা) জমি রয়েছে পূর্ত বিভাগের। এর প্রায় ২২ একর জমিতে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে বস্তিঘর। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী সেখানে ঘর তুলে ভাড়া দিয়ে ফায়দা লুটছে। ২০১৪ সালে এখানে পিপিপির ভিত্তিতে ফ্ল্যাট তৈরির উদ্যোগ নেয় পূর্ত বিভাগ। তখন বলা হয়, এ জমিতে পিপিপির ভিত্তিতে ফ্ল্যাট তৈরি করে পূর্ত বিভাগের প্রাপ্য ফ্ল্যাটগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের বরাদ্দ দিলে আবাসন সংকট কমবে। ডেভেলপার তার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিতে পারবে। পরে ২০১৫ সালে পূর্ত বিভাগ একটি ডিপিপি তৈরি করে দরপত্র আহ্বান করে। চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। তখন ৩৯ শতাংশ ফ্লোর ছিল সরকারের। বাকি ৬১ শতাংশ ছিল ডেভেলপারের। এর মধ্যে প্রকল্প এলাকার আনুষঙ্গিক উপকরণও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু সরকারের লোকসান হবে বলে মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে তখন সেটা স্থগিত হয়ে যায়। এবারে তৈরি করা ডিপিপিতে সেই লোকসান আরও বাড়বে। এবার জমির দাম ধরা হয়েছে ২০১৫ সালের বাজারমূল্য অনুসারে।

নতুন ডিপিপি নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, এবার এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জমির মূল্য পাঁচ হাজার ৪২ কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬২৫ কোটি ১১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে উঁচু জমি কাঠাপ্রতি ২ দশমিক ২৫ কোটি টাকা এবং নিচু জমি কাঠাপ্রতি ১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ডিপিপিতেও জমির মূল্য এ রকমই ছিল।

গুলশান-বনানীসংলগ্ন এলাকায় বর্তমানে জমির বাজারদর ক্ষেত্রবিশেষে কাঠাপ্রতি ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা। তিন বছর ধরে জমির দাম সারাদেশেই বেড়েছে। গুলশান-বনানীতে দুষ্প্রাপ্যতার কারণে জমির দাম বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। কড়াইলের প্রকল্পে জমির দাম কম ধরে প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৪৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ সরকারের এবং ৫০ দশমিক ৯২ শতাংশ অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠানের দেখিয়ে ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে, যা একেবারেই অবাস্তব।

বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, পূর্ত বিভাগের এক কর্মকর্তা গত ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান। একটি ডেভেলপার তাকে কড়াইলের প্রকল্পের জন্য মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তাকে আশ্বস্ত করা হয়, তার জন্য আরও দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থাও করা হবে। এর পরপরই তিনি তড়িঘড়ি করে নতুন ডিপিপি চূড়ান্ত করে অনুমতির জন্য মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করেন।

পূর্ত বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, তিন বছর পর নতুন করে ডিপিপি প্রণয়নের ফলে সরকারের অংশীদারিত্বের পরিমাণ বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। তা ছাড়া ২০১৫ সালের ডিপিপিতে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে প্রকল্প এলাকায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, হেলথকেয়ার সেন্টার, রিটেইল মল ও মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার ও অন্যান্য সুযোগসংবলিত ভবন, পুলিশ স্টেশন ও অন্যান্য সার্ভিস ভবন ছাড়াও কমন ফ্যাসিলিটিজ (বাইরে ও ভেতরে খেলাধুলার সুবিধা, নিচতলায় কার পার্কিং, শিশুদের খেলাধুলার স্থান, লেকের পানি শোধন), দুটি ছোট সেতু, লেকের পাড় বাঁধানো, ১০টি উন্মুক্ত প্যাভিলিয়ন, ১৫টি ডাস্টবিন, বাইরে বসার ব্যবস্থা, মাছ শিকার ও নৌকা চালানোর সুবিধা, সুইমিংপুল তৈরিসহ আরও বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। অথচ চলতি ডিপিপিতে এসব খাতের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ খাতে এবার ডিপিপিতে ৩১৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা পৃথক ব্যয় ধরা হয়েছে। গতবারের ডিপিপিতে এসব আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৭৪ কোটি ৬০ লাখ ৪২ হাজার টাকা। তখন সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণও ছিল এবারের চেয়ে কম- ৪৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এবার প্রকল্প এলাকার ২২ দশমিক ৪০ একর জমিতে বর্তমানে বসবাস করা কয়েক লাখ মানুষের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা রাখা হয়নি। ওইসব বস্তিবাসীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে এ জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে জনরোষের সৃষ্টি হতে পারে।

সম্প্রতি সরেজমিন কড়াইলে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল বস্তির পূর্বপাশেই গুলশান লেক। লেকপাড়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন টংঘর। কিছু আবর্জনাও পড়েছে লেকের ভেতরে। বস্তিবাসীর কানেও ফ্ল্যাট তৈরির খবর পৌঁছেছে। তারা উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে। ফ্ল্যাট প্রকল্পের বিরুদ্ধে একাট্টা হতে চাইছে।

আর্থিক ক্ষতি অন্তত হাজার কোটি টাকা : ৬০ শতাংশ ফ্লোর ভূমি মালিক পেলে এ প্রকল্প থেকে পূর্ত বিভাগ ফ্লোর পেত ১৩ লাখ ৮৯ হাজার বর্গফুট। কিন্তু ৪০ শতাংশের কারণে পাচ্ছে নয় লাখ ২৬ হাজার বর্গফুট ফ্লোর। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার বর্গফুট কম ফ্লোর পাচ্ছে পূর্ত বিভাগ। গুলশান-বনানীতে সাধারণত আবাসিক ভবনে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের মূল্য নূ্যনতম ১০ হাজার টাকা। এ হিসাবে লোকসান দেওয়া চার লাখ ৬৩ হাজার বর্গফুটের দাম দাঁড়ায় ৪৬৩ কোটি টাকা। প্রতি কাঠার সাইনিং মানি (অন্তত ২০ লাখ টাকা হিসাবে) হাতছাড়া হতে চলেছে ৫২৪ কোটি টাকা।

প্রকল্পে যা থাকছে : এ-১ টাইপ ভবন হবে ১১টি। প্রতিটি ৩০ তলা। প্রতি তলার আয়তন হবে ২৭ হাজার বর্গফুট। প্রতি ফ্ল্যাটের আয়তন হবে এক হাজার ৫৫০ থেকে দুই হাজার ৬০০ বর্গফুট। এ-২ টাইপের ভবন হবে চারটি। প্রতিটি হবে ২৯ তলা। প্রতি তলার আয়তন ২৭ হাজার বর্গফুট। ফ্ল্যাটের আয়তন হবে এক হাজার ৫৫০ থেকে দুই হাজার ৬০০ বর্গফুট। বি টাইপের ভবন হবে একটি, ২৩ তলাবিশিষ্ট। প্রতি তলার আয়তন হবে ১৮ হাজার বর্গফুট। সি টাইপের ভবনও হবে একটি, ২২ তলাবিশিষ্ট। প্রতি তলার আয়তন হবে ১৪ হাজার বর্গফুট।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

18 + eleven =