ভূমি মন্ত্রী সতর্ক করলেন কর্মকর্তাদের

0
897

ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম ‘ঝটিকা পরিদর্শনে’ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায় গেলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি।

 

এ অফিসের সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ার পর হঠাৎ করে তিনি সেখানে যান। এর মধ্য দিয়ে ‘দুর্নীতি ও হয়রানি’ রোধে নিজ জেলা থেকেই নিজ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোতে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ শুরু করলেন মন্ত্রী। গতকাল রোববার বেলা পৌনে বারোটায় তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার বিভিন্ন অফিস পরিদর্শন করেন। এসময় মন্ত্রী দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কাজের খোঁজখবর নেন। মন্ত্রীকে পেয়ে বিভিন্ন অভিযোগ জানান অধিগ্রহণ অফিসে আসা ভুক্তভোগীরা। মন্ত্রী ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রশিদের কক্ষে বসে ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতাদের বিভিন্ন অভিযোগ শোনেন। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন সেখানে ছুটে যান। এসময় মন্ত্রী ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বিদর্শী সম্বোদি চাকমাকে ডেকে নেন। তাকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্রী বলেন, ‘তোমার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ আসে কেন? তুমি মানুষকে এত হয়রানি কর কেন? এসময় মন্ত্রী আরো বলেন, একটা বিষয় দাঁড়িয়ে গেছে যদি ভুক্তভোগী কেউ মন্ত্রী কিংবা ডিসির কাছে অভিযোগ করে, তখন নিচের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রতিশোধ নিতে হয়রানি আরও বাড়িয়ে দেন। কাজের গতি হয়ে যায় আরো শ্লো। মন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে বিদর্শী জানান, মামলাসহ নানা জটিলতার কারণে একটু দেরি হয়। এসময় মন্ত্রী তাকে প্রশ্ন করেন, কতদিন ধরে এখানে আছেন? উত্তরে তিনি বলেন, দুই বছর ১০ মাস ধরে। এক কর্মকর্তার এক জায়গায়তো এতদিন থাকার নিয়ম নেই বলে জানান মন্ত্রী। এসময় জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উভয়ে বিদর্শীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশিদ মন্ত্রীকে বলেন, সে (বিদর্শী) চট্টগ্রামে যত বড় বড় প্রকল্প হয়েছে, সবগুলোর কাজ করছে। তার হাত দিয়েই সব হচ্ছে। সে খুব এফিশিয়েন্ট। কাজ বুঝে স্যার। এসময় জেলা প্রশাসক মন্ত্রীকে বলেন, আমাদের বাইরে একটা দালাল চক্র আছে। ভেতরেও যে কেউ নেই সেটা বলব না। সার্ভেয়ারদের একটা গ্রুপ আছে। তবে দালালদের আর্থিক বুনিয়াদ এত শক্ত যে, অনেক সময় কিছু করতে পারি না। কিছু করতে গেলেই তারা অভিযোগ করে বসে। তাদের অভিযোগ থেকে বাদ যায় না ঊর্ধ্বতন অফিসারও। আমাদের অফিসের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে বদলি করে দিচ্ছি। একই সঙ্গে চক্রটাকে ধরার চেষ্টা করছি। দুর্নীতি দমন কমিশনকে বলেছি। জেলা প্রশাসক আরো বলেন, গত সপ্তাহে ৪ জন সার্ভেয়ারকে বদলি করে দিয়েছি। কানুনগোদের পারি না। কারণ উনাদের বদলির কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন বিভাগীয় কমিশনার। এসময় মন্ত্রী বলেন, যেকোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমার মন্ত্রণালয়ে আপনারা অভিযোগ পাঠালেই আমি সাথে সাথে অ্যাকশনে যাবো। জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, এতদিন এ ধরনের অভিযোগ করলেও কাজ হয়নি। এখন আপনি এসেছেন। এখন আমরা যেকোনো অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আপনার দ্বারস্থ হবো স্যার। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিরা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া টাকা থেকে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ কেটে রাখার অভিযোগ পাওয়ার কথা জানান মন্ত্রী। এ বিষয়ে জবাব চাইলে জেলা প্রশাসক আবারও চক্রের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ‘অনেক সময় দেখেছি, আমি নিজে বাড়িতে গিয়ে ক্ষতিপূরণের চেক হাতে তুলে দিয়ে এসেছি। সেই চেক দেখি আবার দালালের হাতে চলে গেছে। এটা কীভাবে যাচ্ছে?’এসময় বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা থেকে আসা মো. সিহাব উদ্দিন মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন, তার ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত্র ফাইল একমাস আগে সার্ভেয়ার পরমেশ্বর চাকমার কাছে পাঠানো হলেও তিনি সেটি ক্ষতিপূরণের জন্য তৈরি করে দিচ্ছেন না। তার কাছে গেলে জানানো হয়, ফাইলটি তিনি বাসায় রেখে এসেছেন। এরপর আরেকবার গেলে বলা হয়- পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মূল কপি নিয়ে যেতে। সেটি নিয়ে জমা দেওয়ার পর তাকে রোববার আসতে বলা হয়। রোববার গেলে তাকে জানানো হয়, ফাইল এবং পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মূল কপি পরমেশ্বর বাসায় রেখে এসেছেন। এভাবে একমাস ধরে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী আরো বলেন, পরমেশ্বর বাবু আমার নম্বর রেখে আমাকে পরে ফোন করবেন বলে জানান। এসময় মন্ত্রী পরমেশ্বর চাকমাকে ডেকে নেন। মন্ত্রী তাকে বলেন, ‘তুমি কি অনেক বড় অফিসার হয়ে গেছ? মন্ত্রীর চেয়েও বড় হয়ে গেছ? গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তুমি নিজের বাসায় কেন নিয়ে যাবে? এই প্রবণতা কেন?’ মানুষকে হয়রানি করার এ মানসিকতা কেন? এটা সহ্য করা হবে না। জবাবে পরমেশ্বর চাকমা বলেন, আমি সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলতেই আমার অফিস সময় শেষ হয়ে যায়। আরও অধিকতর সেবা দেওয়ার জন্য আমি বাসায় ফাইল নিয়ে যায়। রাত জেগে বাসায় কাজ করি। এসময় মন্ত্রী বলেন, অফিসে কাজ শেষ করে ফেলবেন। বাসায় কেন ফাইল যাবে? এটা কোন ধরনের প্র্যাকটিস। মানুষকে ঘুরাবেন না। অভিযোগকারী শিহাবকে উদ্দেশ্য করে জেলা প্রশাসক এসময় বলেন, আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন না কেন? জবাবে শিহাব ডিসি অফিসার চেনেন না বলে জানান। মন্ত্রী বলেন, একটা মানুষের কত টাকা দরকার? হারামের পয়সা নিয়ে কী লাভ? নগরীর কালামিয়া বাজার থেকে আসা আব্দুল মোতালেব মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন, অধিগ্রহণ করা তার জমির ক্ষতিপূরণের জন্য জেলা প্রশাসনে এসে জানতে পারেন, সেই জমির নামজারি অন্যজনের নামে হয়ে গেছে। এ বিষয়ে মামলা দায়েরের পর সেটি নিষ্পত্তি করা হচ্ছে না। বরং পাওয়ার অব এটর্নির কাগজ নিয়ে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি ৩/৮ বছর ধরে এখানে ঘুরছেন বলেও জানান। এসময় জেলা প্রশাসক সিহাব ও মোতালেব দুজনের কাছে কেউ টাকাপয়সা চেয়েছে কি-না জানতে চান। তিনি কেউ টাকা দাবি করেননি বলে জানান। জেলা প্রশাসক মন্ত্রীকে বলেন, ‘কেউ টাকা চাননি। অভিযোগ সময়ের। আমাদের লোকজনের ধৈর্যের এত অভাব! কাজ করার জন্য তো সময় লাগে। সেটাও দেবে না।’ এসময় মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ সার্ভেয়ার পরমেশ্বর চাকমাকে সর্তক করেন এবং পরবর্তীতে অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান। এ সময় তিনি বলেন, আপনাকে ওয়ার্ন করছি। অভিযোগ শক্ত নয় বলে পার পেয়ে গেলেন। পরিদর্শনের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখতে এখানে এসেছি। প্রতিমন্ত্রী থাকার সময়ও ৩ বছর আগে এখানে এসেছিলাম। তখনকার ডিসি অফিস আর এখনকার ডিসি অফিসের মধ্যে অনেক ইতিবাচক তফাৎ আছে। উপরের লেভেলে অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। মিড লেভেলেও বেশি সমস্যা নেই। যত সমস্যা নিচের লেভেলে। আমার মন্ত্রণালয়েও অনেক ঠিক হয়েছে। উপরের লেভেলে অলমোস্ট ৯০ পারসেন্ট ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু নিচের লেভেলের কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি বেশি। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সরাসরি চেক দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তা দালালদের হাতে যাচ্ছে। কীভাবে হচ্ছে তা বুঝছি না। এজন্য ইএফটি (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) পদ্ধতি চালুর চিন্তা করছি। যাতে এক্ষেত্রে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়। ডিসি এক্ষেত্রে ৭ ধারার নোটিশের কথা উল্লেখ করে বলেন, ৭ ধারার নোটিশের পর মামলা মোকাদ্দমার বিষয়টি সমস্যার সৃষ্টি করে। মন্ত্রী বলেন, এ হ্যাজার্ড বিবেচনায় নিয়ে এর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি। এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে তিনি এ সময় বলেন, কাজ চাই। হয়রানি নয়। দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধে জিরো টলারেন্স। ইএফটি বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আবেদনের পর টাকা সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে চলে যাবে এবং সেখানে বিস্তারিত তথ্য থাকবে। এতে হয়রানি থাকবে না। উপস্থিত ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, হয়রানি যাতে না হয় সেভাবে কাজ করতে হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স। আমরা নিজেরাও চাই জনগণ যাতে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার না হয়। হয়রানি ও দুর্নীতি এখানে থাকতে পারবে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘মাইন্ড সেটআপ’ ও পদ্ধতি পাল্টাতে হবে। মন্ত্রী বলেন, আমি এভাবে ঘুরতে থাকবো। চলতে থাকবে এ ধরনের পরিদর্শন। উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, আমরা জানি যেকোন কিছুর পচন উপর থেকে আসে। কিন্তু ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পচন নিচ থেকে আসছে বর্তমানে। এসময় ডিসি বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৫০ শতাংশ তহসিলদারও আমাদের নেই। জবাবে মন্ত্রী তহসিলদার নিয়োগের পরিকল্পনার কথা জানান সংবাদকর্মীদের সামনে। চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ গত মন্ত্রীসভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সন্তান জাবেদকে এবার পূর্ণমন্ত্রী করে একই মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে মন্ত্রী সকাল ১১টায় সার্সন রোডের নিজ বাসায় সংবাদকর্মীদের সাথে কথা বলেন। এসময় তিনি কর্ণফুলী উচ্ছেদ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানান, সরকারি জায়গার উপর যে-ই হোক তাদেরকে উচ্ছেদ করা হবে। এসময় সংবাদকর্মীরা জানতে চান কর্ণফুলী শীপ ইয়ার্ডে থাকা জায়গা উচ্ছেদে কোনো প্রেশার আছে কিনা? জবাবে মন্ত্রী বলেন, যে শক্তিশালীই হোক তাদের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতের নিদের্শনা অনুযায়ী কাজ করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

eighteen − 11 =