অবি ডেস্ক:একের পর এক স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি বের হয়ে আসছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অন্তত ১১টি উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশ দিয়েছে। ২ বছর আগে গঠিত দুদক টিম অনুসন্ধান শেষে এসব সুপারিশ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এর আগে ২০১৭ সালে আইন কমিশনও দেশের স্বাস্থ্য খাতে সমস্যাবলী চিহ্নিত করে এক গবেষণা প্রতিদেন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে ১২৫টির উপরে আইন কমিশন সুপারিশ দিয়েছিল। কিন্তু সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে গতি নেই। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে দুদকের তথ্যে প্রকাশের পর নড়েছড়ে বসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য খাতের ২৩ কর্মকর্তাকে বদলি এবং একজনকে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।
দুদক ও আইন কমিশন দু’বছর আগে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে যে সুপারিশ দিয়েছে সেই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কাজ করা হচ্ছে। জোরদার করা হয়েছে। আস্তে আস্তে উন্নতি হবে। স্বাস্থ্য খাত দ্রুত বড় হচ্ছে। সেভাবে আমার চিকিৎসক ও লোকবল নিয়োগ দিতে পারি নাই। যেসব ঘাটতি আছে তা আস্তে আস্তে কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ঘাটতি থাকলে নানা অনিয়ম হয়।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে কোনো নীতিমালা মানা হয় না। অর্থ আত্মসাতের জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়। কোথাও কোথাও যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও মেরামত দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে যন্ত্রপাতি সরবরাহ বা মেরামত না করেই অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। দুর্নীতির উৎস সম্পর্কে বলা হয়, হাসপাতালগুলোতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ওষুধ থাকলেও রোগীদের তা দেয়া হয় না। দুদকের সুপারিশে বলা হয়, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় এমন উন্মুক্ত স্থানে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শনের বিধান চালু করতে হবে। প্রতিদিন কি কি ওষুধ স্টকে আছে তাও প্রদর্শন করতে হবে। ওষুধ ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে ক্রয় কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জনবল না থাকলে যন্ত্রপাতি ক্রয় না করাই ভালো। ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ইজিপিতে টেন্ডার আহ্বান এবং পিপিআরের বিধানের যাতে ব্যত্যয় না ঘটে তা যথাযথভাবে পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতাল পর্যায়ে যন্ত্রপাতি গ্রহণ সংক্রান্ত কমিটিতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার স্বার্থে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে তারপর যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার বিধান করতে হবে। প্রতিবেদনে দুর্নীতির উৎস সম্পর্কে বলা হয়, স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির দুর্নীতি ছাড়াও প্রশিক্ষণার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায়ও কোনো নীতিমালা মানা হয় না। এক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক অর্থ আদায় করা হয়। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে স্থানীয় দালালদের সমন্বয়ে সংঘবদ্ধ একটি চক্রে পরিণত হয়। রোগী বা তাদের স্বজনদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করে। নির্ধারিত ফি ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে ঝামেলা এড়িয়ে দ্রুত সেবা পাওয়ার আশায় রোগীরা অর্থের বিনিময়ে হাসপাতালের কর্মচারী বা দালালদের শরণাপন্ন হন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ক্রয় কমিটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা না থাকায় সহজেই সরকারি টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে বলা হয়, ক্রয় কমিটির কার্যক্রমে সরকারের যথাযথ নজরদারি না থাকায় ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অন্যান্য পণ্য ক্রয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়। এক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারি টাকা ভাগ-ভাটোয়ারা হয়। উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন হাসপাতালে দক্ষ জনবল নিয়োগ না দিয়েই মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়, যা দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে যায়। কোথাও কোথাও যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও মেরামত দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে সরবরাহ বা মেরামত না করেই টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
দুর্নীতির উৎস সম্পর্কে বলা হয়, সরকারি হাসপাতালে একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র থাকে। এদের কাজ হলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অসহায় গরিব রোগীদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। বিনিময়ে তারা একটি কমিশন পেয়ে থাকে। হাসপাতালগুলোতে নির্ধারিত ওষুধ থাকলেও রোগীদের দেয়া হয় না। এসব ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। কিন্তু দুর্নীতির মাধ্যমে রেজিস্টারে হিসাব মিলিয়ে রাখা হয়। স্বাস্থ্য খাতের এসব দুর্নীতি বন্ধে ২৫ দফা সুপারিশ পেশ করে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে দুর্নীতি কমে আসবে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বন্ধে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। নকল ওষুধ কারখানা বন্ধের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সার্ভিলেন্স টিম গঠন করা প্রয়োজন। অভিযানে কোনো নকল ওষুধ কারখানার সন্ধান পাওয়া গেলে তা তাৎক্ষণিক সিলগালা করে জেল-জরিমানাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নের জন্য চিকিৎসকদের একটি সুনির্দিষ্ট বদলি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সময় চিকিৎসার ফি নেয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ফি অনেক বেশি। এ বিষয়ে নীতিমালা করে পদক্রম অনুযায়ী ডাক্তারদের যৌক্তিক ফি নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া প্রথমবার ফি নেয়ার পর রিপোর্ট দেখানোর সময় আবার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিতে হয়, যা অনুচিত। নীতিমালা করে রিপোর্ট দেখানোর ফি নেয়া বন্ধ করতে হবে। চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম না লিখে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
আইন কমিশনের প্রতিবেদন: আইন কমিশন ‘স্বাস্থ্যসেবা আইন’ নামে একটি আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ গবেষণা কার্যক্রমের আলোকে দেশের স্বাস্থ্য খাতে সমস্যাবলী চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবেদনে কমিশন ১২৫টির উপরে সুপারিশ দিয়েছে। ২০১৭ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি কমিশন তার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার অবস্থা তুলে ধরে গবেষণায় বলা হয় রোগীর সংখ্যা অনুপাতে বেডের সংখ্যা মারাত্মকভাবে অপ্রতুল, প্রায়শই পরিলক্ষিত হয় যে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে, এমনকি হাসপাতালের মেঝেতেও রোগীদের চিকিৎসা দিতে হয়। অথচ একই এলাকার অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে বেড খালি থাকে। ফলে অনুমেয় যে ওই সকল জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসার মান এর ব্যাপারে জনসাধারণ সন্তুষ্ট নয়। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। ওয়ার্ডে কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্স-এর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল, ইন্টার্নি ডাক্তারগণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, কনসালট্যান্ট অধ্যাপক কর্তৃক রোগী পরীক্ষার অনিশ্চয়তা, রোগীর জীবন সংশয় ঘটলেও, বিশেষ করে রাত্রিকালে, সিনিয়র ডাক্তার পাওয়া যায় না, জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা এবং অনেক সময়ই তা বিকল থাকে, ঢ-জধু, টষঃৎধ ঝড়হড়মৎধস, ঈঞ ঝপধহ, গজও ইত্যাদির জন্য অপ্রতুল টেকনিশিয়ান এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিশেষজ্ঞের অভাব, দালালদের প্রতাপ ইত্যাদি। সুপারিশে বলা হয় শক্তিশালী প্রশাসনের মাধ্যমে উপরোক্ত সমস্যাবলী সমাধান করতে হবে, চিকিৎসা সংক্রান্ত্ত সকল তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
জরুরি বিভাগ সংক্রান্ত্ত সমস্যায় বলা হয়েছে, জরুরি চিকিৎসা দেবার জন্য কোনো অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, কনসালট্যান্ট বা সহকারী অধ্যাপক পদায়ন করা হয় না, অথচ ২৪ ঘণ্টায়ই দুর্ঘটনাসহ মারাত্মক অসুস্থতা নিয়ে রোগীরা এই বিভাগে আসতে থাকে। সকল জেনারেল হাসপাতালে আধুনিক স্বয়ংসম্পূর্ণ পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকরী জরুরি বিভাগ থাকা বিশেষ প্রয়োজন, কারণ সব থেকে অধিক সংখ্যক বিপর্যস্ত অবস্থায় পতিতও মুমূর্ষু রোগীই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাত-দিন যেকোনো সময়ে আসতে বাধ্য হয়। বহির্বিভাগ: সরকারি হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় বহির্বিভাগ সমস্যা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয় ডাক্তার, নার্স ও সহায়ক কর্মচারীর মারাত্মক অভাবের ফলে রোগীদের বহু সময় ধরে অপেক্ষমাণ থাকতে হয়, কনসালট্যান্ট বা জ্যেষ্ঠ-অভিজ্ঞ ডাক্তারের অভাব, নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ ইত্যাদি। সুপারিশে বলা হয়েছে-সকল হাসপাতালসমূহের বহির্বিভাগে পর্যাপ্ত সংখ্যক সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও নার্স-এর উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, হাসপাতালে কর্মরত সকল বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও কনসালট্যান্টকে বহির্বিভাগে নিয়মিত দায়িত্ব পালন নিশ্চিতকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হ্রাস পাবে ইত্যাদি। ওষুধ ব্যবস্থাপনায় নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন, অহঃরনরড়ঃরপ সহ যেকোনো ওষুধ অনিয়ন্ত্রিতভাবে যেকোনো ওষুধের দোকান থেকে কিনতে পারা যায়, বেশি লাভের জন্য অযৌক্তিকভাবে ওষুধের উচ্চ মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি। সুপারিশে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের জন্য উপযুক্ত শাস্তি বিধান ও ত্বরিত প্রয়োগ, নির্ধারিত মান রক্ষা করে ওষুধ উৎপাদনের বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করা ইত্যাদি।