অবি ডেস্কঃ মহামহিম আল্লাহর দরবারে আকুল হৃদয়ে রোনাজারিতে মঙ্গলবার শেষ হল ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা। এ সময় কেঁদে বুক ভাসিয়ে কয়েক লাখ মুসল্লি আত্মশুদ্ধি, মুক্তি, দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ এবং ঐক্য কামনা করেন। তুরাগ তীর ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠে।
আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন ভারতের দিল্লির নিযামুদ্দিন মারকাজের মুরব্বি মাওলানা শামীম আহমদ। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট থেকে শুরু করে ১২টা ২ মিনিট পর্যন্ত ১৭ মিনিটের এ মোনাজাতে প্রথম ৮ মিনিট পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করে আল্লাহর দরবারে আরজি জানান তিনি। পরের ৯ মিনিট তিনি উর্দু ভাষায় জানান আকুতি।
তিন দিন ধরে ইজতেমায় অংশ নেয়া লাখো মুসল্লি তো ছিলেনই, আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ভোর থেকেই ঢাকা, গাজীপুর ও আশপাশের এলাকার মানুষ হেঁটেই আসতে থাকেন ময়দানের উদ্দেশে। ময়দানে ঠাঁই না পেয়ে বহু মানুষ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে, পৌঁছতে না পেরে কেউ কেউ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেই অংশ নেন মোনাজাতে।
বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও রেডিও মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচার করে। এর পাশাপাশি মুঠোফোন ও ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মোনাজাতে শরিক হন আরও কয়েক লাখ মানুষ।
১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া প্রথম অংশের (মাওলানা জোবায়ের আহমেদপন্থী, ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীবিরোধী অংশ) আখেরি মোনাজাত শনিবার অনুষ্ঠিত হয়। রোববার থেকে দ্বিতীয় অংশের (মাওলানা সাদপন্থীদের) ইজতেমা শুরু হলে বৈরী আবহাওয়ায় বিঘিœত হয় ইজতেমার কার্যক্রম। পরে ইজতেমার সময় একদিন বাড়িয়ে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় আখেরি মোনাজাত।
মোনাজাত শেষে আগামী বছরের ইজতেমার (সাদপন্থী) তারিখ ঘোষণা করা হয়। এ অংশের মুরব্বি মো. হারুন-অর-রশিদ জানান, ২০২০ সালে ইজতেমা হবে একপর্বে ৩, ৪ ও ৫ জানুয়ারি। তার আগে চলতি বছরের ২২-২৬ নভেম্বর ইজতেমা ময়দানে পাঁচ দিনের জোড় (প্রস্তুতিমূলক সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে মাওলানা জোবায়েরপন্থীরা ২০২০ সালে ১০-১২ ও ১৭-১৯ জানুয়ারি দুই পর্বে ইজতেমার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদের জোড়ও দুই পর্বে এ বছরের ২৯ ও ৩০ নভেম্বর এবং ১-৩ ডিসেম্বর করার ঘোষণা দেন তারা। তবে সাধারণ মুসল্লিরা চাইছেন, বিভেদ ভুলে আগের মতো এক হয়ে ইজতেমা আয়োজন করবেন তাবলিগের মুরব্বিরা।
আখেরি মোনাজাতে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, গাজীপুর জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান প্রমুখ অংশ নেন।
মাওলানা মো. আশরাফ আলী জানান, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান ও চীনসহ ৩৬ দেশের সহস্রাধিক মেহমান এবারের ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। আরেক মুরব্বি মো. হারুন-অর-রশিদ বলেন, বিভিন্ন জটিলতার কারণে এবার বিদেশি মেহমান কম এসেছেন।
মো. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ময়দান থেকে প্রায় ১ হাজার ২শ’ জামাত দেশ-বিদেশের দাওয়াতি কাজে বেরিয়ে গেছেন। এর আগে প্রথম অংশে ১ হাজার ৬শ’ জামাত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতি কাজে ছড়িয়ে পড়েন।
মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষ একযোগে ফেরার চেষ্টা করেন। এতে চরম বিড়ম্বনায় পড়েন এসব মানুষ। টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় তীব্র জনজট ও যানজট। বাস-ট্রেন বা অন্য কোনো যানবাহন- ঠাঁই ছিল না কোনোটিতেই। এর সুযোগে বিভিন্ন পরিবহন বহুগুণ বেশি ভাড়া আদায় করে। এরপরও তিন-চতুর্থাংশ মানুষকেই ঘরে ফিরতে হয়েছে হেঁটে। বিকাল পর্যন্ত এ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।
ভারতের নিজামউদ্দিন মারকাজের শীর্ষ মুরব্বি তাবলিগ জামাতের বিশ্ব আমীর মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে নিয়ে বিরোধ থাকায় এবার তিনি ইজতেমায় আসেননি। তার পক্ষে টঙ্গীতে ৩২ সদস্যের প্রতিনিধি দল ইজতেমায় যোগ দেন। দলের প্রধান (জিম্মাদার) ছিলেন মাওলানা শামীম আহমদ।
সমাপনী বয়ান : আখেরি মোনাজাতের আগে হেদায়েতি বয়ান করেন মাওলানা শামীম আহমদ। বাংলায় তা তরজমা করেন মাওলানা আশরাফ আলী। ভারতের এই মাওলানা ঈমান, আমল, নামাজ, তালিম, এলেম, জিকির ও দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, আল্লাহর রাস্তায় এক সকাল বের হওয়া দুনিয়ার সমস্ত কিছুর চেয়ে উত্তম। যারা দ্বীনের রাস্তায় বের হয় তাদের সঙ্গে ফেরেশতারা থাকেন। আকাশে, পানিতে ও মাটির নিচের সব প্রাণী তার জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকে।
মাওলানা শামীম আরও বলেন, দুনিয়ার জিন্দেগি মিছে জিন্দেগি, বেহুদা জিন্দেগি, ধোঁকার জিন্দেগি। আর আখেরাতের জিন্দেগি চিরস্থায়ী। আল্লাহপাক যদি কাউকে আখেরাতের জিন্দেগিতে কল্যাণ দান করেন তাহলে তার আর কোনো সমস্যা থাকবে না। সেখানে কারও যৌবন শেষ হবে না, সেখানে কারও অসুস্থতা আসবে না, তার কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকবে না।
এর আগে বাদ ফজর উর্দুতে বয়ান করেন দিল্লির হাফেজ ইকবাল নায়ার। তা বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা মুফতি ওসামা বিন ওয়াসিফ।
মোনাজাতে যা বলা হল : আখেরি মোনাজাতে মাওলানা শামীম আহমদ বলেন- হে আল্লাহ, আমাদের গুনাহকে মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, আমাদের ঈমানের হাকিকত ও কামাল নসিব করে দেন। হে আল্লাহ, আমাদের ঈমানি জিন্দেগি নসিব করে দেন। হে আল্লাহ, ঈমানের সঙ্গে মউত নসিব করে দেন। হে আল্লাহ, যে এলেম দুনিয়া ও আখেরাতে উপকারে আসবে আমাদের সে এলেম দেন।
যে অজ্ঞতা আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির কারণ হবে তা থেকে আমাদের উদ্ধার করেন। হে আল্লাহ, সব মুসলমানের ঈমান-আমল, জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুকে হেফাজত করেন। মুসলমানদের এক করে দেন। হে আল্লাহ, দাওয়াতের কাজকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেন। হে আল্লাহ, সব ধরনের ফেৎনা থেকে আমাদের হেফাজত করেন। হে আল্লাহ, বাতিলের সব রাস্তাকে বন্ধ করে দেন। হকের সব রাস্তাকে খুলে দেন। হে আল্লাহ, হকওয়ালাদের রহমত করেন।
তার সঙ্গে আমিন আল্লাহুম্মা আমিন বলতে থাকেন সব শ্রেণী-পেশা-গোষ্ঠীর মানুষ। তারা পরওয়ারদেগার আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চান। মোনাজাতে বহু নারীও অংশ নেন।