হবিগঞ্জে স্বাস্থ্য বিভাগে লোকবল নিয়োগে কোটি টাকার টেন্ডারে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে জেলার সিভিল সার্জন ডা. সুচিন্ত চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে জেলা দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেছেন এক ঠিকাদার।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, হবিগঞ্জে স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মচারী সংকট দূর করতে ৪৮টি পদে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগের অনুমোদন পেলেও সিভিল সার্জনের দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার জন্য টেন্ডার আহ্বানের ৬ মাসের মধ্যেও কার্যাদেশ প্রদান করা সম্ভব হয়নি। বৈধ ঠিকাদারকে কাজ না দিয়ে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে গিয়ে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কাজ দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সুচিন্ত চৌধুরী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৪৮টি পদে লোকবল সরবরাহের জন্য গত বছরের ৫ই সেপ্টেম্বর দরপত্র আহ্বান করে। পদের মাঝে রয়েছে অফিস সহায়ক ১৩টি, ওয়ার্ড বয় ৫টি, নিরাপত্তা প্রহরী ৬টি, বাবুর্চি/সহকারী বাবুর্চী ৬টি, আয়া ৫টি, মালী ২টি ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী ১১টি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১২টি দরপত্র জমা পড়ে। পরে যাচাই-বাছাইকালে যথাযথ কাগজপত্র না থাকায় ১১টি দরপত্র বাতিল হয়। শুধুমাত্র মেসার্স কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের দরপত্র যথাযথভাবে পাওয়া যায়। পরে বোর্ড কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের নাম চূড়ান্ত করে প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রেরণ করে। বাতিল হওয়া ১১টি দরপত্রের মধ্যে ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট অস্পষ্ট এবং কাগজ সত্যায়িত না থাকাসহ নির্ধারিত মূল্যের কমে দরপত্র দাখিল করায় বাতিল হয় ঠিকাদার আফতাব উদ্দিন ফরহাদের দরপত্র ও। কিন্তু প্রভাবশালী ঠিকাদার ফরহাদ সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে সে প্রস্তাব ফেরত আনার ব্যবস্থা করেন। এদিকে, অনুমোদন না হয়ে প্রস্তাব ফেরত আসায় হবিগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ৮ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডে আয়কর নিয়ে আলোচনার পর আয়কর অফিসারের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্যের কারণে কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের দরপত্রই যথাযথ বলে পুনরায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনুমোদনের জন্য ফাইল প্রেরণ করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আবারো সেই ফাইল অনুমোদন না করে সিভিল সার্জন অফিসে প্রেরণ করে। এতে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সুচিন্ত চৌধুরী আবারো একটি বোর্ড গঠন করে তার পছন্দের লোক আফতাব উদ্দিন ফরহাদকে কাজ দিতে উঠে পড়ে লাগেন। সে বোর্ডে অনেক সদস্য অনুপস্থিত থাকলেও রেজ্যুলেশন করে লোক পাঠিয়ে ফরহাদের পক্ষে তাদের দস্তখত নেন। অনেকেই সিভিল সার্জনের অধীনস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। তবে, জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাসনা শারমিন মিথি সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বলেন, দরপত্রটির ১৭নং শর্ত মোতাবেক আয়কর ও ভ্যাট কর্তনের পর প্রস্তাবিত দর সর্বনিম্ন ৯১ লাখ ৯৪ হাজার ৪শ’ টাকা হওয়া প্রয়োজন মর্মে প্রতীয়মান হয়। মেসার্স আফতাব উদ্দিন (ফরহাদ)র প্রস্তাবিত দরপত্র থেকে আয়কর ও ভ্যাট কর্তনের ফলে দরপত্রের শর্তানুযায়ী নির্ধারিত সেবা মূল্য ৯১ লাখ ৯৪ হাজার ৪শ’ টাকা বজায় থাকে না। তার চেয়ে কম আসে যা দরপত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত পূরণ করে না বিধায় তিনি প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। কিন্তু জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধির নোট অব ডিসেন্ট থাকার পরও সিভিল সার্র্জন ফরহাদের নাম প্রস্তাব করে ফাইল ঢাকায় প্রেরণ করেন। পরে এ ঘটনায় প্রথম দুইবার যে ফার্মের নামে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছিল সেই কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আজিজুর রহমান (আজিজ) দুদকে আবেদন করেছেন। আবেদনে বলা হয়েছে সিভিল সার্জন ডা. সুচিন্ত চৌধুরী মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বশীভূত হয়ে আফতাব উদ্দিন ফরহাদকে কাজ দিতে চাইছেন। অথচ প্রাথমিক বাছাইয়ে তার দরপত্র বাতিল হয়েছিল। এ ব্যাপারে আজিজুর রহমান আজিজ বলেন, দরপত্র আহ্বান করা হয় চুক্তিমূল্যের উপর। কমিশনের কোনো কলাম নেই। অথচ চুক্তিমূল্য বাদ দিয়ে কমিশনের উপর আয়কর্তন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আফতাব উদ্দিন ফরহাদকে কাজ দিলে সরকার ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮৮ টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, নীতিমালা মেনেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুধুমাত্র একজন সদস্য সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিলেন। আরেক সদস্য হবিগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা দুইবার প্রস্তাব পাঠানোর পরও অনুমোদন না হওয়ায় নতুন করে প্রস্তাব প্রেরণ করেছি। দেখা যাক ঢাকা থেকে কি সিদ্ধান্ত হয়। এদিকে, ৬ মাস যাবৎ লোকবল নিয়োগের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় জেলার অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ও গোপলার বাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজনও লোক না থাকায় সেখানে কোনো কার্যক্রম নেই। আবার অনেক স্থানে মাত্র ১ জন লোকবল আছেন। বর্তমান টেন্ডারের মেয়াদ ৩০শে জুন পর্যন্ত। ফলে এখানে সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সুচিন্ত চৌধুরী বলেন, এখন যে সিদ্ধান্ত হয়েছে এটিই সঠিক। জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধির নোট অব ডিসেন্ট সহকারেই প্রস্তাব ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি বলে তিনি জানান।