দেশে শাকসবজি, চিংড়ি ও শুঁটকিতে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশকের উপস্থিতি ধরা পড়ে কয়েক বছর আগেই। এবার পাওয়া গেল চালে মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী ধাতু।
গবেষকরা বরাবরই বলে আসছেন, ফসলের জমিতে অপ্রয়োজনীয় ও যথেচ্ছ মাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার আর কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য থেকে পানি ও মাটি দূষণের মাধ্যমে ফসলে ঢুকে পড়ছে নানা ধরনের ভারী ধাতুসহ বিষাক্ত উপাদান। ওই সব উপাদান মানুষের বা যেকোনো প্রাণিদেহে সৃষ্টি করে নানা রকম জটিল রোগের ঝুঁকি। চালে রাসায়নিক দূষণের প্রমাণ মিলেছে সরকারি সংস্থার গবেষণায়ই। ওই গবেষণার ফল আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির উদ্যোগে গত বছর দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় চালে মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এতে চালের ২৩২টি নমুনার মধ্যে ১৩১টিতে বিভিন্ন মাত্রায় মানুষের জন্য বিপজ্জনক ক্রোমিয়াম, ১৩০টিতে ক্যাডমিয়াম, সমসংখ্যক নমুনায় সিসা, ৮৩টিতে আর্সেনিকের অস্তিত্ব মিলেছে। এ ছাড়া ২০টি নমুনার মধ্যে তিনটিতে পাওয়া যায় আফলাটক্সিন। এ ক্ষেত্রে আফলাটক্সিনের মাত্রা (০.০০০৪-০.০০১৩) সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (০.০১) নিচে থাকলেও ৫৬টি নমুনায় ক্রোমিয়াম, ১৭টিতে ক্যাডমিয়াম, ২২টিতে সিসা এবং পাঁচটিতে আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে মানুষের শরীরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ইউরোপীয় কমিশনের নীতিমালা অনুসারে মানবদেহের জন্য ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ১ পিপিএম। কিন্তু ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি বা জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের গবেষণায় চালে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে ৩.৪১৪ পিপিএম পর্যন্ত। ক্যাডমিয়ামের সহনীয় মাত্রা ০.১ হলেও পাওয়া গেছে ৩.২৩৯৫ পর্যন্ত। সিসার সহনীয় মাত্রা ০.২ হলেও পাওয়া গেছে ১.৮৭ পর্যন্ত। জানা গেছে, ওই গবেষণায় চাল বা ধান ছাড়াও আলু, বেগুন, টমেটো, মাছ, মুরগির মাংস, কলের পানি, তরল দুধ ও গরুর খাবার নিয়েও কাজ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে শুধু গরুর দুধ ও খাবারের বিষয়ে গবেষণার ফল চূড়ান্ত হওয়ায় গত মাসে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। বাকিগুলো প্রকাশ করার প্রক্রিয়াও প্রায় চূড়ান্ত। গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, তরল দুধ, গোখাদ্য ও দইয়ে ক্রোমিয়াম-ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতু রয়েছে। পাওয়া গেছে কীটনাশকেরও অস্তিত্ব। ছিল ক্ষতিকর মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক। বিশেষ করে, গরুর খাবারের ৩০টি নমুনার মধ্যে ৬৯ থেকে ১০০ শতাংশে কোনো না কোনো রাসায়নিকের উপস্থিতি মিলেছে। কোনো কোনোটিতে একই সঙ্গে কয়েক ধরনের রাসায়নিক পাওয়া যায়। ১৬টিতে ছিল ক্রোমিয়াম। অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় সব নমুনাতেই। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের পরামর্শক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন ওই গবেষণার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘সব কটি গবেষণারই ফল তৈরি হয়ে গেছে। এর মধ্যে দুধের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছে। বাকিগুলো চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটু গুছিয়ে সেগুলোও প্রকাশ করা হবে। এ কারণেই আপাতত বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছে। তবে এই ফল থেকে যাতে মানুষের মধ্যে কোনো রকম ভীতির সঞ্চার না হয় সেটিও আমাদের গোপনীয়তার একটি কারণ; যদিও আমরা চাই মানুষকে সচেতন আর সতর্ক করতে। সেই সঙ্গে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যাতে খাদ্যচক্রকে মানুষের জন্য নিরাপদ রাখার কার্যকর উদ্যোগ নেয়, সেটিও আমাদের প্রত্যাশা।’ আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইআরআরআই) বাংলাদেশ অফিসের প্রধান ড. হোমনাথ ভাণ্ডারি বলেন, ‘বাংলাদেশে ধানে ভারী ধাতুর বিষয়ে আমরাও নজর রাখছি। এরই মধ্যে এ বিষয়ে আমাদের তরফ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটি গবেষণা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেই গবেষণার ফলে কী আসে, আমরা তা দেখার অপেক্ষায় আছি।’ভারী ধাতুতে মানুষের যত সর্বনাশ : রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক মানুষের শরীরে ঢুকলে তা বের হতে পারে না। সব কটিই দীর্ঘ মেয়াদে কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়া ক্যান্সারসহ নানা ধরনের ক্রনিক রোগের বড় উৎস হচ্ছে এসব রাসায়নিক। এককথায় এগুলোর সব কটিই ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম। রোগতত্ত্ববিদ মাহামুদুর রহমান আরো বলেন, কয়েক বছর আগে আরেকটি গবেষণায়ও চালের মধ্যে সিসাসহ আরো কিছু ভারী ধাতুর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু পরে আর তা নিয়ে বড় কোনো গবেষণা হয়নি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন বলেন, কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিণতি কমবেশি সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিশুরা সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। বিশেষ করে, সঠিক মান রক্ষা করে এবং প্রয়োগবিধি না মেনে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে একাধারে উৎপাদিত ফসল, মাছ, পানি ও জমি মারাত্মকভাবে বিষাক্ত হয়ে থাকে। এর যেকোনো মাধ্যম থেকে মানুষের শরীরে সহজেই ঢুকে পড়ছে এই বিষাক্ত উপাদান। খাদ্যচক্রে যেভাবে যায় ভারী ধাতু : অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘ফসল ও মাছে ভারী ধাতু ঢুকছে মূলত মাটি ও পানি থেকে। মাটি ও পানি এমনভাবেই রাসায়নিক দূষণের কবলে পড়েছে, যা খাদ্যচক্র হয়ে মানবদেহে ঢুকে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। নানা ধরনের জটিল রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে মানুষকে। দিনে দিনে এ সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সর্বাত্মক সচেতনতা ও সতর্কতা। কলকারখানার বর্জ্য থেকে ভয়ানক বিপদে পড়ছে আমাদের খাদ্যচক্র। পরিবেশদূষণের মাত্রা যত কমানো যাবে ততই মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ কমবে, মানুষের সুরক্ষা ঘটবে। সেই সঙ্গে চাষাবাদের সময় জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারও বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিকভাবেই আর্সেনিকের প্রভাবও রয়েছে দেশের বেশির ভাগ এলাকায়। অনেক রাসায়নিক ও কীটনাশকযুক্ত ঘাস-পানি বা লতাপাতা গবাদি পশু খেলে তা দুধ, ডিম কিংবা মাংসের মাধ্যমে মানুষের দেহে তো ঢুকবেই। এর মধ্যে ভারী ধাতুগুলো আগুনের তাপেও নষ্ট হয় না, মানুষের শরীরে জমে জমে ক্ষতি করতে থাকে।’ আইআরআরআইয়ের ড. হোমনাথ ভাণ্ডারিও বলেন, রাসায়নিক দূষণযুক্ত পানি-মাটি আর ফসলে ব্যবহৃত সার-কীটনাশক থেকেই ধানে ভারী ধাতু যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হুমায়ূন কবীর সিরাজী বলেন, ‘শিল্প-কারখানার বর্জ্য-দূষণ এখন মাটির জন্য বড় বিপদ ডেকে এনেছে। আমি নিজেই সম্প্রতি কয়েকটি এলাকায় পর্যবেক্ষণে গিয়ে যে চিত্র দেখেছি, তা রীতিমতো ভয়ানক। এমনও মাটি পেয়েছি, যেখানে কোনো গাছপালা, ফসল হয় না শুধু রাসায়নিক দূষণের কারণে। আবার এমনও দেখেছি, রাসায়নিক দূষণের কারণে ফসল নষ্ট হয়েছে। ওই ফসল খাওয়ার পর গবাদি পশু অসুস্থ হয়ে পড়ার কথাও আমাকে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে।’ কয়েক বছর আগে এক গবেষণায় শাকসবজি, চিংড়ি ও শুঁটকিতে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশকের অস্তিত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)। দেশের ১২ জেলা থেকে সংগৃহীত ৪৫৪টি নমুনা পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে বারি ওই তথ্য জানিয়েছিল। ২০১৫ সালের মার্চে অষ্টম ওয়ান হেলথ বাংলাদেশ সম্মেলনে উপস্থাপিত এসংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এখনই ব্যবস্থা না নিলে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। ওই সম্মেলনে উপস্থাপিত আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাতে সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।