স্টাফ রিপোর্টার: ১৯৭১ সালে ৭ই মাচ পূর্ববঙ্গের রাজধানী শহর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আর্তনাৎ “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রম” ৭ কোটি পূর্ব বাঙালীকে একবৃত্তে দাড় করিয়ে ছিলো শুধুমাত্র একটি দাবীতে “স্বাধীনতা, স্বাধীনতা”। তার ঠিক ১৭ দিন পরে ২৫ মার্চ কালো রাতে সেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। একই সাথে আমাদের ঘুমন্ত জাতির উপর ঝাপিয়ে পড়ে হায়েনার মতো। মেতে উঠে রক্তের হোলি খেলায়। গুলিবর্ষণে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এক রাতেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই একটি কথা “তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম” কালজয়ী কথাটাকে পুজি করে আমাদের সন্তানেরা ২৬ মার্চ থেকে ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র যুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন ভ’-খন্ড “বাংলাদেশ”। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে ছিলো আমাদের সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ, চাকুরীজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি সাহিত্যিক, কৃষক-শ্রমিক সহ নানা শ্রেনী পেশার মানুষ। কেউ সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলো আবার কেউবা সশস্ত্র যোদ্ধাদের সংগঠিত করে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলো। যাদের অনেকেই যুদ্ধকালীন শহীদ হন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এসব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে করা হয় মুক্তিযাদ্ধাদের তালিকা। একটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা। অপরটি বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। প্রদান করা হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান মুক্তিযুদ্ধের সনদ। তবে যুদ্ধ ফেরত অনেকেই আবার দেশের জন্য জীবনের আত্মত্যাগ মনে করে সেই তালিকায় নিজের নামটা অন্তর্ভুক্ত করেননি। ফলে তারা বঞ্চিত হন রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে। কিন্তু আজো তারা বঞ্চিত সেই সম্মান থেকে। তাদের মৃতুর পর গার্ড অব অনার দিতে না পেরে কাঁদে তাদের সহযোদ্ধাদের হৃদয়।
তাদেরই একজন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার কৃতিসন্তান,মানুষ গড়ার কারিগর আব্দুস সামাদ মোল্লা ওরফে সামাদ স্যার। তিনি ১৯৪৬ সালে ১ লা জানুয়ারী শ্যামসিদ্দি ইউনিয়নের সেলামতি গ্রামের মরহুম কালু মোল্লা ও মরহুমা জহুরা বেগম দম্পতি ঘরে জন্ম নেন। কিশোর বয়স থেকেই নরম স্বভাবের অধিকারী ও যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র আব্দুস সামাদ মোল্লা। ১৯৬৪ সালে স্যার জগদ্বিশ চন্দ্র বসু ইন্সষ্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে জগন্নাথ কলেজর বিজ্ঞান শাখা থেকে এসএইচসি ও ১৯৬৯ সালে বিএসসি পাশ করে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকতার পেশাটাকে আপন করে নেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শোষন আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বারুদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ৬৬-এর ছয়দফা ও ৬৯-এর গণ অভ’্যত্থান সহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে রাজপথে অংশ গ্রহন করেন। ৭০-এর নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামীলীগের হয়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালিত করেন। ও ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল গাজীর কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। দক্ষতার সাথে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুর্নঃগঠনের কাজে নিজেকে শিক্ষকতায়ই মগ্ন রাখেন। একজন যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করার বিনিময়ে কোন কিছু পাওয়ার লোভ লালসা করেননি। তিনি বিশ^াস করতেন শিক্ষকতাই তাকে অনেক সম্মান দিবে আর ঘটেছেও ঠিক তাই। তিনি মরেও বেঁচে আছেন তার হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে, একজন সনামধন্য শিক্ষক হিসেবে শ্রীনগর বাসীর অন্তরে।
মুক্তিযুদ্ধে তার সহযোদ্ধোদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সামাদ স্যার ছিলেন অত্যান্ত সাদা মনের একজন মানুষ। “কোন কিছুর বিনিময়ে কোন কিছু পেতে হবে” এই নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন কাজ করলেই কাজের সফলতা আসবে। তিনি বলতেন মুক্তিযুদ্ধ করেছি দেশের জন্য। দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন কর্ম করতে হবে। তাই তিনি যুদ্ধ শেষে শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর হাই স্কুলে গনিত বিষয়ে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হন। পরবর্তীতে শ্রীনগর পাইলট হাই স্কুলে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত গনিতের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৪ সালে স্ট্রোক করে দীর্ঘ অসুস্থ্যতা নিয়ে ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিজ বাসভবনে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে রেখে যান। তার মৃত্যুতে ছাত্র-শিক্ষক সহ শ্রীনগর উপজেলার বিভিন্ন স্তরের লোকজন শোক প্রকাশ করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটে তার নাম না থাকায় স্থাণীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করতে পারেনি।
এব্যাপারে শ্রীনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল গাজী বলেন, সামাদ মাষ্টার আমার কমান্ডে আমার সহ যোদ্ধা ছিলেন। তবে কি কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার তার নাম নেই এটা আগে জানতে পারিনি। গেজেটে নাম না থাকার কারনে আমরা তাকে “গার্ড অব অনার” দিতে পারিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তার মৃত্যুর পর “গার্ড অব অনার” দিতে না পারা যে কত কষ্ঠকর তা বলে বুঝাতে পারবোনা। আরো আটদশ জন মুক্তিযোদ্ধার মতো আমিও চাই মরনোত্তর হলেও সামাদ মাষ্টারকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান করা হউক।
সামাদ স্যারের ছাত্র বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের ডা: এনায়েত হোসেন বলেন, সামাদ স্যার অত্যান্ত ভালো মনের একজন মানুষ ছিলেন, গনিত বিষয়ে একজন দক্ষ শিক্ষক ছিলেন। সবচেয়ে গর্বের বিষয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার কোন চাওয়া পাওয়া ছিলো না। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আব্দুস সামাদ স্যারের ছেলে এডভোকেট জহিরুল ইসলাম রবিন বলেন, আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ পরিবারে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। ছোট বেলা থেকে বাবার মুখে বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। আমিও শ্রীনগর সরকারী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক, শ্রীনগর উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও ধানমন্ডি ল‘ কলেজের আওয়ামী আইন ফোরামের সদস্য হিসেবে দীর্ঘ দিন রাজনীতি করেছি। আমি গর্বিত আমার বাবা এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দেখলাম মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটে তার নাম না থাকায় তাকে “গার্ড অব অনার” দেওয়া হলো না। তখন বিষয়টা আমাকে অনেক কষ্ঠ দিয়েছে। আমি ১৮ কোটি বাঙালীর ভাগ্য উন্নয়নের একমাত্র পরিচালক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, চারবারের নির্বাচিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আবেদন জানাচ্ছি যেন আমার বাবাকে মরনোত্তর হলেও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ইহা ব্যতীত আমার অন্য কোন চাহিদা নেই।