ঘুম থেকে ডেকে তুলে এনে ডাকাতির প্রস্তুতি মামলায় গ্রেপ্তার

0
616

ঘুম থেকে ডেকে তুলে এনে ডাকাতির প্রস্তুতি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাতজনকে ক্যামেরার সামনে হাজির করে পুলিশ। পরে তাদের আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঘুমন্ত মানুষকে বাড়ি থেকে তুলে এনে ডাকাত বানিয়ে দিয়েছে বগুড়ার শাজাহানপুর থানা পুলিশ।

ধুনট উপজেলা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করার পর শাজাহানপুরে ডাকাতির প্রস্তুতি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ভুক্তভোগীদের পরিবার ও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে পুলিশের এই সাজানো অভিযান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

শাজাহানপুর থানার ওসি গত সোমবার জানিয়েছিলেন সড়কে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে সাত ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভোররাত ৩টার দিকে সোনাহাটা সড়কের সাঘাটিয়া পাকুড়তলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত রশি, একটি করাত, দুটি হাঁসুয়া এবং একটি সিএনজিচালিত অটোটেম্পো উদ্ধার করা হয়। সোমবার বিকেলে ডাকাতি চেষ্টা মামলা দায়েরের পর আসামিদের আদালতে পাঠানো হয়।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, পুলিশ যাদের ডাকাত বলছে তারা আসলে নিরীহ মানুষ। নিজের বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের ধরা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন ধুনট উপজেলার বিলচাপড়ি গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর মোমিন শাহ (২৫), ব্যবসায়ী মশিউর রহমান মাসুম (৩৮), কলেজছাত্র দেলোয়ার হোসেন (২৫), দিনমজুর শফিকুল ইসলাম (২৮), কীটনাশক ব্যবসায়ী মশিউর রহমান (৪২), দিনমজুর শহিদুল ইসলাম (৩৪) ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক রজব আলী (৪৪)।

গ্রেপ্তার হওয়া মশিউর রহমান মাসুমের স্ত্রী শাকিলা খাতুন অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামীসহ সাতজন গ্রেপ্তার অভিযান পুলিশের সাজানো নাটক। ভোরে চারজন পোশাকধারী পুলিশ ও বোরকা পরা একজন এবং মুখ বাঁধা পাঁচ-সাতজন ধুনটের বিলচাপড়ি ও রামনগর গ্রামে যায়। তারা গেট ভেঙে সাধারণ মানুষের বাড়িতে প্রবেশ করে। এরপর ঘুম থেকে জাগিয়ে সাতজন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় তারা নারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি, গালাগাল ও অশালীন আচরণ করে। অনেকের বাড়ি থেকে জোর করে মোবাইল ফোন নিয়ে আসে।

ওই গৃহবধূ আরো জানান, দিনের বেলায় তারা ধুনট থানায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন এই থানার কেউ তাদের স্বজনদের গ্রেপ্তার করেনি। গুম-খুনের আশঙ্কায় তারা চিন্তিত ও হতাশ হয়ে পড়েন। মঙ্গলবার সকালে তারা জানতে পারেন, এই সাতজনকে শাজাহানপুর থানা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতির প্রস্তুতির মামলা দেওয়া হয়েছে। অথচ এই সাতজনকে গ্রেপ্তার করার ঘটনা পুরো গ্রামের মানুষ অবগত আছে।

অনুসন্ধানকালে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ধুনটের বিলচাপড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নাজনিল নাহার বলেন, ‘আমি দেখেছি পুলিশের এই অভিযান। পুলিশ অভিযানকালে বাড়ির নারীদের মারধর করে। তাদের আসবাব ভাঙচুর করে। পরে ওই সাতজনকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে যায়।’

এলাঙ্গি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ তারেক হেলাল জানান, এই সাতজনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। পরে শাজাহানপুর থানায় সাজানো সড়ক ডাকাতি চেষ্টায় আটক দেখানো হয়েছে। বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারা কিভাবে ডাকাতি করবে? অভিযানকালে আমি পুলিশ সদস্যদের কাছে নাম জানতে চাইলে তারা সেটি বলেনি। কারণও বলেনি। শুধু বলেছে, ‘অভিযোগ আছে।’ তবে এই অভিযানকালে পুলিশ যেভাবে নারীদের ওপর হামলা ও ভাঙচুর করে তা নিন্দনীয়।

কথা হয় গ্রেপ্তার হওয়া মশিউরের বড় ভাই প্রভাষক আনিছুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ধুনট থানা পুলিশকে না জানিয়ে অন্য থানার মধ্যে ঢুকে শাজাহানপুর থানা পুলিশ বাড়ির দরজা ভেঙে, ত্রাস সৃষ্টি করে এমন কাজ করবে এটা আশা করা যায় না।’

দেলোয়ারের স্ত্রী সালমা আক্তার বলেন, ‘বর্তমানে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’

গ্রেপ্তার হওয়া শফিকুলের স্ত্রী মফেলা বেগম বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলাম। ভোররাতে গেটে ধাক্কাধাক্কি শুনে খুলে দিলে পুলিশ সদস্যরা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আমাদের সঙ্গে অশালীন অচরণ করে তারা। পুলিশের সঙ্গে মুখবাঁধা বোরকা পরা লোকজন বাড়ির সবকিছু ভেঙে ফেলে। ভয়ে আমরা প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি।’

ধুনট থানার পরিদর্শক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘অভিযান কী কারণে তা আমরা জানি না। পরে গ্রামবাসীর মাধ্যমে এই সাতজনের বিষয়টি জানতে পারি।’

শাজাহানপুর থানার পরিদর্শক আজিম উদ্দিন বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে ডাকাতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা ডাকাতি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।’

অনুসন্ধানকালে আরো জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া মশিউর রহমান বিলচাপড়ি গ্রামে বালুর ব্যবসা করেন। তাঁর সঙ্গে শাজাহানপুরের আমরুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান অটলের ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্ব। অটল ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। এই দ্বন্দ্বর জের ধরে অটল তার এলাকায় মাসুমের ব্যবসা বন্ধ করে দেন। একই সঙ্গে তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এ ঘটনার দুদিন পর পুলিশ এই অভিযান চালায়।

জানতে চাইলে অটল বলেন, ‘আমার এলাকায় চুরি ও ছিনতাই বেড়ে গেলে আমি ওসি আজিম উদ্দিনকে অভিযান চালানোর অনুরোধ করি।’

বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূইয়া বলেন, ‘তদন্ত করে অবশ্যই দোষী হলে ব্যবস্থা নেব।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × four =