একটা সময় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে জনপ্রতি ৮/১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো। টাকার অঙ্ক শুনে অনেক যোগ্য ও মেধাবী তরুণ ফরমও নিত না। কনস্টেবল পদপ্রত্যাশী বেশিরভাগ তরুণই দরিদ্র পরিবারের। এসব দরিদ্র পরিবারের মেধাবী তরুণদের পক্ষে এতো টাকা যোগাড় করা সম্ভব ছিল না। তবে বদলে গেছে এ চিত্র। এবার পুলিশ সদর দপ্তরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিয়োগ পেয়েছেন দরিদ্র পরিবারের মেধাবী তরুণরা।
প্রশাসন চাইলে কি-না সম্ভব! এর বাস্তব প্রমাণ মিলল কনস্টেবল নিয়োগে। পুলিশ প্রশাসনের সদিচ্ছায় কোনো প্রকার অর্থ লেনদেন, দুর্নীতি, অনিয়ম ও তদবির ছাড়াই স্বচ্ছতা ও মেধার ভিত্তিতে প্রায় ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ হয়েছে। যারা চাকরি পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই কৃষক, রিকশাচালক, দিনমজুরসহ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আর এর জন্য তাদের ব্যয় হয়েছে মাত্র ১০৩ টাকা। তিন টাকা ফরমের মূল্য। আর ১০০ টাকা ট্রেজারি চালান বাবদ।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে আইজিপিকে ডেকে নিয়ে বলেন, পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম থাকবে না। চাকরি পেতে ৮/৯ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কেউ জমি বিক্রি করে, ধার-দেনা করে ঐ টাকা যোগাড় করে। এ কারণে ঐ পুলিশ সদস্য চাকরিতে যোগ দিয়েই ঐ টাকা উঠানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে—এটাই স্বাভাবিক। তাই আমি পুলিশে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পরই ছক কষে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। অপরদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে ছিলেন শক্ত অবস্থানে।
জানা গেছে, এবার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের চেষ্টা করার অভিযোগে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে তাত্ক্ষণিক শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার দেহরক্ষী ও চালকসহ কেউ কেউ অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দালাল ও প্রতারকদের মাধ্যমে নিয়োগ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ঘুষ লেনদেন করারও অভিযোগ আসে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন জেলায় এ পর্যন্ত ১৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। একজন এসআইসহ ৪০ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে এবার প্রস্তুতি ছিল অনেক। এ ব্যাপারে ক্রাইম কনফারেন্সে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন আইজিপি। এ কনফারেন্সে আসা এসপি ও ডিআইজিদের আইজিপি সাফ জানিয়ে দেন, এ বছর নিয়োগ হবে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত। এরপর প্রতিটি জেলায় মাইকিং ও পোস্টার করে জানিয়ে দেওয়া হয়, পুলিশে নিয়োগ হবে স্বচ্ছ। কেউ কাউকে অর্থ লেদদেন করবেন না। দালালদের খপ্পরে পড়বেন না।
প্রতিটি জেলায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট জেলার এসপি এবং দুই জেলার দুজন অতিরিক্ত এসপি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া মনিটরিং করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরে গঠিত দুই সদস্যের টিম প্রতিটি জেলায় গেছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি জেলায় ঐ টিম অবস্থান করে। এছাড়া প্রতিটি জেলায় একটি গোয়েন্দা টিম মনিটরিং করেছে, যেটা কাউকে জানানো হয়নি। আবার এই গোয়েন্দা টিম ঠিকমতো কাজ করছে কি না সেজন্য কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স টিম নিয়োগ করা হয়।
এদিকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। খাতা কীভাবে দেখা হবে সেজন্য নাম-ঠিকানা রেখে দিয়ে শুধু কোড নম্বর দেওয়া হয়। পরে কোড নম্বর অনুযায়ী ফলাফল বসানো হয়। পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে সিলগালা প্রশ্নপত্র খোলা হয়। পরীক্ষা কেন্দ্রে পেনড্রাইভসহ কোনো ধরনের ডিভাইস নেওয়া নিষেধ ছিল। একেবারে নিখুঁতভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এসএসসি পরীক্ষার আদলে এ নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে। ১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৩ জন প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। কোনো এসপির বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে সেখানে অতিরিক্ত ডিআইজি পাঠানো হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা ছিল। সবাইর সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। এ নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে আরো বড়ো ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এমপি-মন্ত্রীরাও। তারাও সহযোগিতা করেছেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রক্রিয়ায় পুলিশে নিয়োগ প্রদান সম্ভব হয়েছে। জেলার পুলিশ সুপারদেরও ভূমিকা ছিল। এতো বড়ো সফলতা আসায় তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।