ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হলে আইনের তো কোনো আপত্তি দেখি না

0
602

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অপরাধকাণ্ড সংঘটনের জলজ্যান্ত দৃশ্যের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করা ভিডিও রেকর্ড টিভি ও ইন্টারনেটে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে।

দু-একটির আবার অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, অভিপ্রায়ের অডিও রেকর্ডও একইভাবে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। চাক্ষুষ প্রমাণ এসব ইলেকট্রনিক রেকর্ড আদালতে সাক্ষীসাবুদ হিসেবে ব্যবহার করলে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করতে বেগ পেতে হয় না বলে কথা উঠেছে।

সেই সঙ্গে বিতর্কও উঠেছে এসব ইলেকট্রনিক রেকর্ড আদালতে সাক্ষীসাবুদ হিসেবে ব্যবহারের আইনগত সুযোগ নিয়ে।

আদালতে সাক্ষীসাবুদ ব্যবহারের নীতি পদ্ধতি বিষয়ে আমাদের দেশে রয়েছে ১৮৭২ সালের অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট। এখানে মূলত দু’ধরনের অ্যাভিডেন্সের কথা আছে- প্রথমত, মৌখিক অর্থাৎ সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হয়ে যা কিছু বর্ণনা করেন, দ্বিতীয়ত, ডকুমেন্টারি অর্থাৎ আদালতের নিরীক্ষণের জন্য যেসব ডকুমেন্ট উপস্থাপন করা হয়।

ডকুমেন্ট হিসেবে যে পাঁচটি উদাহরণ এ আইনের ধারা ৩-এ দেয়া আছে, তাতে এখনকার এসব ইলেকট্রনিক অডিও বা ভিডিও বা অডিওভিজুয়াল রেকর্ড নেই।

না থাকারই কথা, ১৮৭০ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত স্যার জেমস ফিটজজেমস স্টিফেন সাহেবরা যখন ড্রাফট করেছিলেন, তখন এ ধরনের রেকর্ড যে আগামী দিনে কখনও আসতে পারে, তা কল্পনা করার মতোও বাস্তবতা ছিল না।

তাই বলে তারা একেবারে অদূরদর্শী ছিলেন সে কথাও বলা যাবে না ডকুমেন্টের সংজ্ঞাটি খুঁটিয়ে দেখলে। তাদের ড্রাফটিং অনুযায়ী ডকুমেন্ট হল- স্মারক হিসেবে ধরে রাখার জন্য কোনো অক্ষর, সংখ্যা, চিত্র, চিহ্ন, সংকেত এককথায় যে কোনো রকম আঁকিবুঁকির মাধ্যমে কোনো বস্তু বা পদার্থে ফুটিয়ে তোলা কোনো ব্যাপারস্যাপার। [‘Document’ means aû matter expressed or described upon aû substance by means of letters, figures or marks, or by more than one of those means, intended to be used, or which may be used, for the purpose of recording that matter.]

এসব অক্ষর, সংখ্যা, চিত্র, চিহ্ন, সংকেতের আঁকিবুঁকি (letters, figures or marks, or by more than one of those means) কলম দিয়ে, না রংতুলি দিয়ে, না হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে তা নির্দিষ্ট নয়। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হলে আইনের তো কোনো আপত্তি দেখি না।

অডিও-ভিডিও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের যে হার্ডডিস্ক, মেমোরি বা চিপে ধরে রাখা হয় সেগুলো ‘substance’-এর মধ্যে না পড়ার তো কারণ দেখি না।

আমি ইলেকট্রনিক অডিও বা ভিডিও বা অডিওভিজুয়াল রেকর্ডে ১৮৭২ সালের অ্যাভিডেন্স অ্যাক্টের সংজ্ঞায়িত ডকুমেন্টের সব উপাদানই দেখছি। উদাহরণগুলোই তো শেষ কথা হতে পারে না।

দালিলিক আর মৌখিক সাক্ষ্যের বাইরে আরেক ধরনের সাক্ষ্যও বিচারকাজে হরহামেশাই ব্যবহার হয়, যেটাকে বলা হয় বস্তুগত বা বাস্তব সাক্ষ্য (Material or Real Evidence), আমাদের আদালত অঙ্গনে যা আলামত নামে সমধিক পরিচিত।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৫ ধারার বিধান অনুযায়ী তদন্ত কর্মকমর্তা অপরাধ সংশ্লিষ্ট যে কোনো আলামত জব্দ করতে পারেন, করেনও।

আর ১৮৭২ সালের অ্যাভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৬০-এর ২নং শতাংশের বিধান ও ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারের ১৬১ বিধি অনুযায়ী আদালতে বিচারের সময় আলামত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অপরাধকাণ্ড সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনিক অডিও বা ভিডিও বা অডিওভিজুয়াল রেকর্ড আলামত হিসেবেও গ্রহণ না করারও কোনো যুক্তি দেখি না।

সাক্ষীসাবুদ গ্রহণ করার যেসব পদ্ধতি ১৮৭২ সালের অ্যাক্টে দেয়া আছে, তা দিয়েই ইলেকট্রনিক সাক্ষীসাবুদ গ্রহণ করা মোটেও অসম্ভব নয়।

তার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা, আইনজীবী ও বিচারকদের প্রকৃত বিচারে দৃঢ়চেতা, বিচক্ষণতা ও সদিচ্ছার প্রয়োগ দরকার। প্রায় ১২০০ আইনের এই দেশে আইন তেমন বাধা হয়নি আমার কাছে, কূটতর্ক না তুললে আসলেই তেমন বাধা নয়।

কিন্তু মুশকিল হল, আমার এ মতের সঙ্গে আমি ছাড়া আর সবাই ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন এবং আমার বিশ্বাস ভিন্নমতের বিজ্ঞের সংখ্যা বেশিই হবে।

পুলিশ কর্মকর্তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রামে ক্লাস নিতে গিয়ে একবার তাদের একজনের অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম যে, তিনি মোবাইলের কল রেকর্ড নাকি এক আদালতে গ্রহণ করাতে পারেননি। আর আমি চেয়েও এ রকম সাক্ষ্য বা আলামত পাইনি তদন্ত কর্মকর্তা সময়মতো তা জব্দ না করায়।

‘যত জন তত মত’ বন্ধের জন্যই আইন স্পষ্ট থাকা জরুরি। আইনের অস্পষ্টতার শিকার সচরাচর নিরীহরাই হন, আর ফায়দা পান দুর্জনেরা- অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই-ই। ‘জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটেশনের’ মাধ্যমে আইনের অস্পষ্টতা সুপ্রিমকোর্ট দূর করেন যদি বিষয়টি সে পর্যন্ত যায়।

কিন্তু ততদিনে শুধু তো যমুনায় জলই গড়িয়ে যাবে না, ঘটে যাবে অনেক বিচারবঞ্চনা। আবার, সুপ্রিমকোর্টের সে সিদ্ধান্ত সব তদন্ত কর্মকর্তা, আইনজীবী, বিচারকের তাৎক্ষণিক অবগতিতে থাকেও না।

আমাদের দেশে ১৯৮৫ সালে ৩৭ ডিএলআর ২৭৫ পৃষ্ঠায় হাইকোর্ট বিভাগ সেই সময়ের ভিডিও ক্যাসেট ডকুমেন্টারি অ্যাভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলেছেন।

তারও আগে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এআইআর ১৯৬৪ এসসি ৭২ পৃষ্ঠায়, এআইআর ১৯৬৮ এসসি ১৪৭ পৃষ্ঠায় এবং পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট পিএলডি ১৯৭৬ এসসি ৫৭ পৃষ্ঠায় টেপ রেকর্ডকে ডকুমেন্টারি অ্যাভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এসব সিদ্ধান্ত কাজে লাগানোর নজির খুব একটা পাওয়া যাবে না।

তাই, সংশ্লিষ্ট আইনের বিধানগুলোই সুস্পষ্ট থাকা কাম্য।

আদালত দু-একটি সুনির্দিষ্ট ব্যতিক্রম ছাড়া সবসময় সাক্ষ্য চায় আসলটা, তা সে মৌখিক, ডকুমেন্টারি বা আলামত যা-ই হোক। সাক্ষীসাবুদে নকলবাজি, জালিয়াতির ব্যাপার আগেও ছিল, এখনও আছে। এখনকার ডিজিটাল যুগে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিতে এই নকলবাজি, জালিয়াতির সুযোগ আরও প্রশস্ত।

তাই ইলেকট্রনিক সাক্ষীসাবুদ গ্রহণ করার পদ্ধতি, আসলটা না থাকলে কী ধরনের কপি কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, আসল-নকলের ফারাক বোঝার কী উপায় হবে- এসব বিষয় আইনে সুনির্দিষ্ট থাকা প্রয়োজন। ভারত ২০০০ সালে যখন ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট করে তখনই ১৮৭২ সালের অ্যাভিডেন্স অ্যাক্টের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সংশোধন করে ডিজিটাল যুগোপযুগী করে নিয়েছে।

শুধু এভিডেন্স অ্যাক্টই নয়, ১৮৬০ সালের পেনাল কোড, ১৮৯১ সালের ব্যাংকার্স বুকস অ্যাভিডেন্স অ্যাক্টও একই সঙ্গে সংশোধন করে নিয়েছে ওই ইনফরমেশন টেকনলজি অ্যাক্ট দিয়েই। ওই সময় ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি থাকলে স্টিফেন আর মেকলে সাহেবরা যা করতেন ভারত তাই করে নিয়েছে।

আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইন হয়েছে ২০০৬ সালে। তখনই আমাদের অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট, পেনাল কোড, ব্যাংকার্স বুকস অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট ইত্যাদি ডিজিটাল যুগোপযুগী করে ফেলার কথা। কিন্তু তা হয়নি।

এরপর দীর্ঘ সময় চলে গেছে, চলে যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক সাক্ষীসাবুদের গ্রহণযোগ্যতা ও গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য আমাদের আইনগুলোর সংশোধনও এখনই প্রয়োজন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × two =