মানুষ তৈরির কারিগর মানবহিতৈষী ডিআইজি হাবিবুর রহমান

0
804

বিশেষ প্রতিনিধি: ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উত্তরণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। এই সংগঠনের মাধ্যমেই হিজড়া ও বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে আলো ছড়ানো হচ্ছে। ঢাকার আশুলিয়া, আমিনবাজার ও বি-বাড়িয়ায় হিজড়াদের জন্য গড়ে তোলেন তিনটি বিউটি পার্লার। এ পার্লারগুলো নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছে হিজড়াদের। তাদের মূল পেশার (প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা) বাইরে এনে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেদে সম্প্রদায়ের জন্য বুটিকসহ নানা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শিক্ষালয়। মুন্সীগঞ্জে একটি স্কুলে বেদেদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখছে। বেদেপল্লীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ সম্প্রদায়ের জন্য তৈরি হচ্ছে মিউজিয়াম। আর এসব মানবিক কাজে হাত দিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন-ডিসিপ্লিন) হাবিবুর রহমান। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও এনজিও এগিয়ে আসছে।


এ প্রসঙ্গে ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সমাজে উন্নয়নের জন্য পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে হবে। তাদের নানাভাবে কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায় মানুষ হয়েও তারা মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত। সঠিক দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় ও বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এ জন্য তাদের আলোর পথ দেখাতে হবে।

এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বেদেপল্লী ও হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, বুটিক, কম্পিউটার ট্রেনিং, ফ্যাশন হাউস ও বিউটি পার্লারসহ নানা ধরনের কর্মসংস্থানমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে শিক্ষালয়। সারা দেশেই এর কার্যক্রম গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। সংবিধানে সকলের জন্য সে অধিকার রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধু।

তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সেই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে কাজ করে চলেছেন।’
জানা যায়, ঢাকার অদূরে সাভারের বংশী নদীর তীরে পোড়াবাড়ি, অমরপুর, কাঞ্চনপুর ও বাড্ডা গ্রামে প্রায় দেড়শ বছর আগে বসতি গড়ে তোলেন বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যরা। ওই পল্লীতে তাঁদের সদস্য এখন প্রায় ১৫ হাজারের মতো। আর ব্যতিক্রমী ও মানবিক পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এ মানুষগুলোর জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছেন ডিআইজি হাবিবুর রহমান।

কিভাবে একটি জনপদ, একটি সম্প্রদায়কে পাল্টে দেওয়া যায় তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো অন্যরাও যদি এগিয়ে আসেন তাহলে সমাজে অভাব-অনটন, হানাহানি থাকবে না বলে অনেকেই মনে করেন। উত্তরণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডিআইজি হাবিবুর রহমান। সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করছে তাঁর এ প্রতিষ্ঠানটি। পিছিয়েপড়া বেদে জনগোষ্ঠীর জন্য আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিগত ‘উত্তরণ কম্পিউটার সেন্টার’ ও ‘উত্তরণ শিক্ষালয়’ নামে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয় মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ খড়িয়া গ্রামের বেদেপল্লীতে।

কম্পিউটার সম্পর্কে শিক্ষা আর উত্তরণ শিক্ষালয় থেকে শিশু শ্রেণি থেকে কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। আর যাঁরা পাঠদান করান তাঁরাও বেদে সম্প্রদায়ের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া সন্তান। যেসব শিশু স্কুলে যায় তাদের প্রতিদিনকার স্কুলের পড়া ও বাড়ির কাজ বা হোমওয়ার্ক ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় এই শিক্ষালয় থেকে। আবার যারা এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি, অথচ পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ আছে তাদের এ শিক্ষালয় থেকে পাঠদানে সহযোগিতা করা হয়। এই শিক্ষালয়ে প্রতিদিন দুই শিফটে ৮০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কথা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক মো: শাকিলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি বেদে সম্প্রদায়েরই একজন।

এখন লৌহজং বিশ্বদ্যািলয় কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। আরো তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেদে সম্প্রদায়ের সদস্য এ শিক্ষালয়ে পাঠদান করাচ্ছেন। পাঠদানের জন্য উত্তরণ ফাউন্ডেশন আমাদের কিছু সম্মানিও দিচ্ছে।’ আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় উত্তরণ বিউটি পার্লার ১-এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্যদিকে সাভারের হেমায়েতপুরে মাওলানা শপিং কমপ্লেক্সে হিজড়াদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য চালু করা হয়েছে ‘উত্তরণ বিউটি পার্লার-২’। এ বিউটি পার্লারের পরিচালনায় আছে পাঁচজন হিজড়া সদস্য। এটা পরিচালিত হচ্ছে হিজড়া সদস্য সোহাগীর মাধ্যমে। এ প্রতিষ্ঠানে আরো কাজ করেন নাসিমা, ঈসা খান, মিলন ও মুন্নি হিজড়া।

এ ছাড়া বি. বাড়িয়া পৌর এলাকার টেংকেরপারের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তরণ বিউটি পার্লার-৩। জানা যায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পার্লারটি যাত্রা শুরু হয়। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া এর উদ্বোধন করেন। সঙ্গে ছিলেন, হিজড়াদের বিউটি পার্লারের স্বপ্নদ্রষ্টা পুলিশের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। পার্লারটিতে নারীদের ফেসিয়াল, চুল কাটা, পার্টি সাজ, বউ সাজ ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে।


কর্মক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক (পিপিএম) পুরস্কার পান ডিআইজি হাবিবুর রহমান। এর আগে তিনবার তিনি বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) পেয়েছেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে এই পদক পরিয়ে দেন।
সেবা, সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য পুলিশ সপ্তাহে পদক দেওয়া হয় যা বিপিএম এবং পিপিএম নামে পরিচিত। প্রথমটি বাংলাদেশ পুলিশ পদক এবং পরেরটি রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক।


ডিআইজি হাবিব পুলিশের অ্যাডমিন অ্যান্ড ডিসিপ্লিন হিসেবে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত আছেন। তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং অনন্য সাধারণ পেশা দারিত্বের সাথে প্রতিপালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের প্রশাসন, পার্সোনেল ম্যানেজম্যান্ট, ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স শাখার কার্যক্রম তদারকি করেন। দেশের দুই লক্ষাধিক পুলিশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছেন। পুলিশের ডিজিটালাইজেশন ও প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ই-ফাইলিং, পুলিশ সদস্যদের যাবতীয় তথ্যাবলি পিআইএমএসের মাধ্যমে সংরক্ষণসহ পুলিশের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।


হাবিবুর রহমান ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্র দিঘলীয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চন্দ্রদিঘলীয়া মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষনা ইনস্টিটিউট থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ১৭তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে পুলিশে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি পুলিশের একজন ডিআইজি হিসেবে পুলিশ হেডকোয়ার্টার এ দায়িত্ব পালন করছেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 + 7 =