জাবিতে শিক্ষকদের উস্কানিতে আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা, হল বন্ধের ঘোষণা

0
414

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে শাখা ছাত্রলীগ। ঘটসাস্থলে উপস্থিত থেকে দেখা যায়, উপাচার্যপন্থী কয়েকজন শিক্ষকের প্রত্যক্ষ্য মদদেই ছাত্রলীগ এ হামলা চালায়। হামলায় শিক্ষক- শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আটজনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে জানান জাবি চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. রেজওয়ানুর রহমান। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক জরুরী সিন্ডিকেট সভা ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য হল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। বিকেল সাড়ে চারটার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আজ দুপুর আড়াইটার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনে অনুষ্ঠিত জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও সিন্ডিকেট সচিব রহিমা কানিজ এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।


এরআগে বেলা ১১টার দিকে উপাচার্যপন্থী শিক্ষক, কর্মকর্তা- কর্মচারীরা শহীদ মিনার থেকে একটি মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের দিকে যায়। এসময় তারা জানান, উপাচার্য অধ্যপক ড. ফারজানা ইসলামকে অবমুক্ত করতেই তাদের এ যাত্রা। মিছিলটি উপাচার্যের বাসভবনে প্রবেশ করতে চাইলে আন্দোলনকারীদের বাঁধার মুখে পড়ে।

এসময় দুপক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে। এরমধ্যেই বেলা পৌনে ১২টার দিকে ক্যাম্পাস শিবির মুক্ত করতে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সেখানে যায় ছাত্রলীগ।

তখনই উপাচার্যপন্থী আট-দশজন শিক্ষক আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করতে ছাত্রলীগকে ডাকতে থাকে এবং হাততালি দিয়ে ছাত্রলীগকে স্বাগত জানায়। এছাড়া উপাচার্যপন্থী কর্মকর্তাদের ‘ধর ধর’, ‘জবাই কর’ স্লোগান দিয়ে হামলায় উস্কানি দিতে দেখা যায়।

একপর্যায়ে আন্দোলনে শিবির আছে আখ্যা দিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। অবস্থা এমন দাড়ায় যে হিন্দু ধর্মাম্বলী এক আন্দোলনকারীকেও শিবির বলে মারধর করে।
হামলা চলাকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।


এ হামলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও শহীদ রফিক জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ সোহেল আহমেদ, পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও আল বেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ আশরাফুল আলম,

গণিত বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগের অধ্যপক এটিএম আতিকুর রহমান, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের প্রভাষক ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুর রহমান জনি, নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. মোসাব্বের হোসেন, ইন্সটিটিউট অব রিমোট সেনসিং- এর মো. মনির হোসাইন সহ কর্মকর্তা- কর্মচারীরা।


হামলায় আহত শিক্ষকরা হলেন- নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা সহ আরো কয়েকজন।


আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে- ৪৪ তম আবর্তনের দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুল ইসলাম রনি, ৪৮ তম আবর্তনের ইংরেজি বিভাগের আলিফ মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগের উল্লাস, তম আবর্তনের দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল, প্রতœতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচীর নাম জানা গেছে।

এছাড়া ৪৪তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্রী ছন্দা ও ৪৭ তম আবর্নের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাউদা নামের দুই নারী শিক্ষার্থীকেও মারধর করতে দেখা গেছে। মারধরের সংবাদ সংগ্রহের সময় আহত সাংবাদিকরা হলেন- প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি আজাদ,

বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু, বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জল। ছাত্রলীগের মারধরের বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এরকম ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।

উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উস্কানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে তখন ভিসিপন্থী শিক্ষকরা তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে হাততালি দিয়েছে।”


আর হামলার বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, “আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল।” তবে আন্দোলনে শিবির সম্পৃক্ততার ছাত্রলীগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আন্দোলকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন।

তিনি বলেন, “আন্দোলনে কোন শিবির সংশ্লিষ্টতা নেই। যেকোন শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির অপবাদ দেয়াটা পুরোনো অপকৌশল। বুয়েটের আবরারকে এভাবেই হত্য্ াকরা হয়েছে, এখানেও একইভাবে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে।

উপাচার্য অপসারণ আন্দোলনের সাথে যুক্ত এমন অনেকেই আজ ছাত্রলীগের হামলায আহত হয়েছে যারা ক্যাম্পাসে বামপন্থী রাজনীতির চিহ্নিত মুখ। তাই তাদের এসব কথা তাদের দুর্নীতি ঢাকার অপকৌশল।” হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ.স.ম. ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, “ঘটনাস্থলে মব তৈরি হয়েছিল। চেষ্টা করেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।

বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি।” মারধরের ঘটনার আধাঘন্টা পরে উপাচার্য তার সমর্থক শিক্ষকদের সাথে নিয়ে তার কার্যালয়ে যান। পরে সেখানে তিনি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, “আমার সহকর্মী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের এ গণ অভ্যূত্থানের জন্য ধন্যবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন খুলে দেয়া হয়েছে।

এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে।” এর আগে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের আলোচনায় কার্যত কোন সমাধান না আসায় অবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামকে অবরুদ্ধ করা হলো।

সোমবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’- এর ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে একটি মিছিল বের করে আন্দোলনকারী শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে বসে যায়। উপাচার্য অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ থাকবে বলে জানিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × 3 =