এই শীতে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন সমুদ্র উপকূলীয় গ্রামবাংলার চাষিরা

0
1962

আনোয়ার হোসেন আনু, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী):এক সময় গ্রাম বংলার যেদিকেই তাকানো হতো সেদিকেই খেজুর গাছ আর গাছ দেখা যেতো। এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না। মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ার সাথে সাথে খেজুর গাছও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষ এখন আর খেঁজুর গাছ রোপন করে না। খেঁজুর গাছকে এখন মধ্যবিদ্ধ পরিবার জঞ্জাল মনে করে। এক যুগ আগেও খেঁজুর গাছের বেশ কদর ছিল। গাছ কেটে মানুষ এখন দালান কোঠা ও বাগান বাড়ি তৈরী করছে। সেখানে কাটায় ভরা এই খেঁজুর গাছের স্থান কোথায়। এক সময় খেঁজুর রস খাবার জন্য এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে যেত রস সংগ্রহ করার জন্য মানুষ। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না।

মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ার সাথে সাথে পরিবর্তণ হয়েছে এর চাহিদারও। মানুষদের মধ্যে এর চাহিদাও তেমন একটা দেখা যায় না। তারপরও গ্রাম বাংলার নিন্ম ও মধ্যবিত্ত মানুষের মাঝে এর চাহিদা আগের মতই রয়ে গেছে।

খেজুর রস শীত কালে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় যেন এক গুরুত্ব পূর্ণ উপাদান। স্বপ্ন ও প্রত্যাশায় অনেক খানি খেজুর গাছের সঙ্গে চাষীদের অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই বসবাস হয়ে উঠে। নানা ভাবে জড়িত চাষীর জীবন সংগ্রামে অনেক কষ্টের মাঝে প্রাপ্তিই যুক্ত হয় বাংলার এমন জনপ্রিয় বৃক্ষ খেজুর গাছের সঙ্গে। ভূমিহীন চাষী, প্রান্তিক চাষী, দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের জন্যেই যেন এমন সময়টা অনেক আনন্দদায়ক। কারণ খেজুর গাছই তো ওইসব চাষীর অন্নদাতা। কাকডাকা ভোরে খেঁজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে পায়েস রান্না করে খাবার মজাটাই আলাদা। এ স্বাদ যেন ফুরায় না।

 চাষীদের কাছ থেকে জানা গেছে, হেমন্তের শেষেই শীতের ঠান্ডা পরশে গ্রামবাংলার হরেক রকমের চাষী খেজুর গাছের মিষ্টি রসে নিজকে ডুবিয়ে নেওয়ার সুন্দর মাধ্যম সৃষ্টি করে। আবহমান গ্রামবাংলার চাষীদের যেন একঘেয়েমির যান্ত্রিকতায় জীবনযাপনের অনেক পরিবর্তন আনে শীতকালের ঋতুচক্র। শীতকালে বৈচিত্রপুর্ণ গ্রামীণ সংস্কৃতির মাঝেই যেন ‘খেজুর রসের পিঠা’ শৈল্পীক ঐতিহ্যের বহুমুখী সমারোহ কিংবা প্রাণোচ্ছলতায় বারবারই ফিরে আসে। তাদের খেজুর গাছের যতœ-আত্তি না করলে যে রস মিলবে না।

আর রস না মিললে গুড় হবে না। পাটালি.মুচি মিঠা না দেখলে যেন ঘুম আসে না চাষীর। পাটালি গুড়ের মিষ্টিমধুর গন্ধে চাষীরা বিক্রয় কাজে না থাকলে পেটে ভাত জোটেনা। শীতের আমেজে প্রকৃতির মাঝ হতে সংগ্রীহিত খেজুর রস চাষীরা যেন চষে বেড়ায় সকাল, বিকেল ও সন্ধ্যায় মেঠো পথ ধরে, তারই বহিঃপ্রকাশে যেন চমৎকার নান্দনিকতা এবং অপরূপ দৃশ্য অনুভব করে, তা যেন অবশ্যই এক শৈল্পীকতার নিদর্শন। এমন শৈল্পীক আস্থা ও বিশ্বাসকে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে কুয়াশা চাদরে মুড়ি দিয়ে রস সংগ্রহ করতে হয়। এই শীতেকালে রূপ সৌন্দর্যের আর একটি উপাদেয় সামগ্রী খাঁটি শরিয়া তেল, যা শরীরে মালিশ করে অনেকাংশেই ত্বকের মশ্রিণতা এবং ঠান্ডা দূর করে খেজুর গাছে উঠতে।

গ্রামে খুব ভোরে খেজুর গাছ হতে রসের হাড়ি নামিয়ে আনতে ব্যস্ত হন চাষী। রাতের এ হিমশীতল রস ভোরে হাড় কাঁপানি ঠান্ডায় গাছ থেকে নামিয়ে খাওয়ার যে স্বাদ তা একেবারেই আলাদা। ভোর বেলায় রস খেলে শীত আরো অনেক জাঁকিয়ে বসে। আবার শীতে শরীর কাঁপানির এক স্পন্দন যেন চরম আরামদায়ক। শীত লাগে লাগুক না, তবুও রস খাওয়ার যেন বিরাম নেই।

এই শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালে গ্রামের ছেলে মেয়েরা ঘুম থেকে খুব ভোরে উঠে হাত মুখ ধুয়ে খড় কুটোয় আগুন জ্বেলে হাত পা গরম করে এবং অপেক্ষা করে কখন রোদের তেজ প্রখর হবে। তাদের রোদ পোহানোর আরামের সঙ্গে আরও অপেক্ষা, তা হলো তাদের প্রিয় খেঁজুর রস আর রসের পায়েস। গ্রামবাংলার অভাবী মেয়েরা খেঁজুর পাতায় মাখিয়ে রং বেরংয়ের খেজুর পাতায় খেজুর পাটি তৈরী করে তার উপরই যেন চলে রস খাওয়ার আসর। উপার্জনের জন্য খেজুর পাতা শুকিয়ে তা দিয়ে খেজুর পাটি তৈরী পর বিক্রয় করে সংসারের কিছুটা অর্থ সংকুলান করা হতো এক সময়।

এই খেজুরের পাটিতেই গ্রামের অনেক পরিবার ঘুমানোর কাজে তা ব্যবহার করে। খেজুর পাতায় এক ধরনের সাহেবী টুপিও তৈরি হয়। খেজুরের পাতা, ডাল এবং গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। আর মোরব্বা তৈরিতেও খেজুর কাটার ব্যবহার প্রচলিত আছে। এক কথায় বলা চলে খেজুর গাছের পাতা ও ডেগা কবরেও ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে এখনও। চাষীরা জানান, খেজুর গাছ ছয় সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে। পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত রস দেয়। গাছ পুরনো হয়ে গেলে রস কমে যায়।

পটুয়াখালীর মহিপুর থানার সুধীরপুর গ্রামের আমির হোসেন বলেন, পুরনো খেজুর গাছের রস খুব মিষ্টি হয়। মাঝ বয়সী গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা গাছের জন্য আবার অনেক ক্ষতিকর। রস সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। কার্তিক মাস থেকেই রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে রস ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।

 বিপিনপুর গ্রামের মফেজ হাওলাদর বলেন, শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ মাস হলো রসের ভর মৌসুম। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত একটি খেজুর গাছে মাসে ৪০ কেজি রস পাওয়া যেতে পারে।  নিজামপুরের ফরিদ ফকির জানান, খেজুর গাছ শুধু রস দিয়েই ক্ষান্ত হয় না।

শুকনো খেজুরে ভেষজ গুন অনেক রয়েছে, খেজুরের বীজগুলো বাহির করে নিয়ে দুধে খেজুর গুলো মিশিয়ে ভাল ভাবে ফুটিয়ে গরম করে এই দুধ খেজুর ঠান্ডা করে শিশুকে খাওয়ালে শক্তি বাড়ে৷ আবার একটি শুকনো খেজুরের ফলের পুষ্টি মান তুলে ধরে বলা যায়, প্রায় ৭৫-৮০% শর্করা, ২% আমিষ এবং প্রায় ২.৫% স্নেহজাতীয় পদার্থ থাকে। ১০০ গ্রাম শাঁসে ২০ ভাগ পানি, ৬০-৬৫ ভাগ শর্করা, ২ ভাগ আমিষ এবং খুব সামান্য কপার, সালফার, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ, বি-১, বি-২ এবং খনিজ লবণ খোঁজে পাওয়া যায়।

চাষীরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান এ গাছে থেকে সে গাছে। ভোরে রস সংগ্রহ করে রসের হাড়ি নামিয়ে শুকাতে দেয়া হয়। বিকেলে গাছ কাটার পর হাড়ি গুলো আবার গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। মাটিতে পা ফেলার ফুরসতটুকুও পায় না এই মানুষ গুলো। শীত আসা মাত্রই খেজুর গাছ কাটার জন্য তৈরী হয়ে যায় চাষীরা। খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়।

আর এই গাছ গুলো কাটে যারা তাদেরকে ‘গাছি’ বলা হয়। তারা বিভিন্ন উপকরণ সমন্বয়ে গাছি নাম ধারি মানুষ পরিচ্ছন্ন ভাবে গাছ কাটার জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। তারা গাছ কাটতে ব্যবহার করেন দা, দড়ি, এক টুকরো চামড়া বা পুরনো বস্তা। আবার দা রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি থলি বা টোনা। সে ঝাঁপি গাছিরা রশি দিয়ে খুব যতেœ দা রেখে এ গাছ থেকে সে গাছে উঠা, নামা করে সুবিধা পায়। আবার কোমরে বেশ কিছু চামড়া বা বস্তা বেঁধে নেয় যেন গাছে উঠা নামায় কোন প্রকার সমস্যা না হয়। গাছ কাটার জন্য গাছি শরীরের ভারসাম্য রক্ষার সময় কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়। এমনি ভাবেই গাছিরা অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে খেঁজুর রস সংগ্রহ করে। রস দিয়ে মিঠা তৈরী করে তা বাজারে বিক্রি করে চলে তাদের সংসার জীবন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twelve − one =