আমার বিরুদ্ধে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে

0
701

দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিদর্শক বিজয় কুমার ঘোষ দেশে ও বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নাম ভাঙিয়ে ও বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমানকে হাত করে ১০ বছর ধরে অপকর্ম চালিয়ে আসছেন তিনি।

বিজয় কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে কমিটি হলেও পাঁচ মাস পরও বোর্ডে প্রতিবেদন জমা পড়েনি। অথচ কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। তবে অভিযোগ তদন্তে কমিটি হলেও সাময়িক বরখাস্ত না করায় এখনো স্বপদে রয়েছেন তিনি। কিন্তু বিজয় কুমার ঘোষের দাবি, ‘আমার বিরুদ্ধে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে।’

২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের একজন উদ্যোক্তা তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বিজয় কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। সেখানে বলা হয়, ‘আপনার সঙ্গে তোলা ছবি এবং আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে বিজয় কুমার ঘোষ মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিমূলক কাজ করে আসছেন। ২০০৯ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের পিএস থাকা অবস্থায় নানা রকম অপকর্ম শুরু করেন তিনি। এরপর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পদে বসানোর পর তিনি দেশের বিভিন্ন জেলার  হিসাবরক্ষকসহ কর্মচারীদের বদলির ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেন। ফলে কর্মচারীদের রোষানলে পড়ে তিনি গণপিটুনি খান। এরপর শিক্ষামন্ত্রীকে ম্যানেজ করে কৌশলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিদর্শক পদে বসেন। এরপর থেকে তিনি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠেন।’ অবৈধ উপার্জনের টাকায় তিনি রাজধানীর রূপনগরে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এরপর চলতি বছরের জুনে বিজয় কুমার ঘোষের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের চালা এলাকার বাসিন্দারা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে একটি চিঠি দেয়। এতে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তিনি কীভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন তা তদন্ত করার অনুরোধ জানানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, বিজয় কুমার ঘোষ উত্তরায় বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন ও গ্রামের বাড়ি চালায় পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। আর দুর্নীতির বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন সিরাজগঞ্জের রিজিওনাল অফিসে ঋণের জন্য আবেদন করেছেন তিনি। তবে রিজিওনাল ম্যানেজার তাকে ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তার হাত থেকে রেহাই পাননি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান। মেয়াদ শেষ হলেও বোর্ডের চেয়ারম্যানের চাকরি আরও দুই বছর বর্ধিত করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিজয় কুমার ঘোষ।’ এ ছাড়া তিন বছরেরও বেশি ধরে কীভাবে তিনি কারিগরি বোর্ডে কর্মরত আছেন চিঠিতে সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে।

গত জুন মাসে শরীয়তপুরের এক উদ্যোক্তা কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আরেকটি অভিযোগপত্র জমা দেন। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবদের পিএস, পিএ, এপিএস, মন্ত্রীদের পিএস, এপিএসদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সচিবালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দোহাই দিয়ে নানারকম অপকর্ম করে যাচ্ছেন বিজয় কুমার ঘোষ। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। আর এই অর্থ দিয়ে ভারতের বারাসাতে একাধিক প্লট কিনেছেন এবং একটি প্লটে ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন বিজয় কুমার। কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা বাঁচানোর স্বার্থে তাকে বোর্ড থেকে অপসারণ এবং অপকর্ম ও অবৈধ সম্পদের বিষয়ে জরুরি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও এতে বলা হয়।

এরপর গত ২৩ জুন সাবেক পরিচালক মীর মোশাররফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। পরে মীর মোশাররফ হোসেন অবসরে গেলে বোর্ডের সচিব মাহবুবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটিকে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়। তবে পাঁচ মাস পরও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি কমিটি।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মোরাদ হোসেন মোল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিজয় কুমার ঘোষের দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম শেষের পথে।’ অভিযোগ ওঠার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত না করে তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি মূলত মাউশির কর্মকর্তা, বোর্ডে তিনি ডেপুটেশনে আছেন। তাকে বরখাস্ত করার এখতিয়ার আমাদের নেই।’

তদন্ত কমিটির প্রধান মাহবুবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত গুছিয়ে এনেছি। প্রতিবেদন লেখাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। খুব শিগগির প্রতিবেদন জমা দিয়ে দেব।’ কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেন, ‘বিজয় কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশকিছু সত্যতা পাওয়া গেছে। খুব দ্রুতই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’

এদিকে উপ-পরিদর্শক বিজয় কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কারিগরি বোর্ডে আমি ডেপুটেশনে আছি। আমার তো এখানে থাকার কথা নয়, আমি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। এখানে বসার কথা টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তার। যেহেতু মন্ত্রণালয় আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে সে কারণে আছি। আর আমি এখানে আছি দেখে অনেকেরই তা সহ্য হয় না। আমাকে সরানোর জন্য বিভিন্নভাবে বহুদিন ধরেই ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ গেছে তার সবই এই ষড়যন্ত্রের অংশ।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর আগেও আমার বিরুদ্ধে এমন অনেক অভিযোগ দিয়েছে অনেকেই। তদন্ত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে আমাকে নির্দোষ বলা হয়েছে। তাছাড়া অভিযোগকারীদের নাম-পরিচয় সঠিক পাওয়া যায় না। বর্তমানে আমার বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছে সেগুলোও ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে। আমি ষড়ন্ত্রের শিকার।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

two × 3 =