দুর্নীতির দমন বিভাগে দুর্নীতি

0
504

দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ফাঁদ টিম ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। কিন্তু এই সুনামকে পুঁজি করে দুদককে বড় ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বাধীন ফাঁদ টিম। তিনি নৌপরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি ঠেকাতে একরকম ভাড়া খাটেন। প্রতিপক্ষ গ্রুপের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের সুবিধা নিয়ে সাজানো ঘুষ লেনদেনের ফাঁদ পেতে মীর্জা মো. সাইফুর রহমান নামে এক কর্মকর্তাকে আটক করে প্রায় ৫ মাস জেল খাটিয়েছেন। যিনি অভ্যন্তরীণ নৌযান জরিপকারক ও নিবন্ধক হিসেবে ঢাকার নদীবন্দর সদরঘাট কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। দুদকের সাজানো ফাঁদে তিনি গ্রেফতার না হলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী পদে তার ওই সময় এক সপ্তাহের মধ্যে পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার কয়েকজন সহকর্মী প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পদোন্নতি ঠেকাতে একরকম জঘন্য পথ বেছে নেন। সাজানো ঘটনার পুরো আলামত নষ্ট করতে চক্রটি ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করে দেয়। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি গত সেপ্টেম্বর মাসের। সূত্রে জানতে পারি, জামিন পাওয়ার আগেই এই মামলায় ৪ মাস ২৪ দিন জেল খাটতে হয়েছে ভুক্তভোগী মীর্জা সাইফুর রহমানকে। গত ২৭ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে তিনি ন্যায়বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি দুদকের শীর্ষ পর্যায় গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। অভিযোগের সত্যতা যাচাইসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ইনহাউস তদন্ত শুরু হয়েছে। গুরুতর অপরাধ বিবেচনায় বিষয়টি নিয়ে সিআইডি পৃথকভাবে তদন্ত করছে।

যা ঘটেছিল সেদিন : সেদিন ছিল ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর। জরুরি ফোন পেয়ে নৌপরিবহন অধিদফতরের মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে মাসিক সমন্বয় সভায় যোগ দেন মীর্জা সাইফুর রহমান। বৈঠক শেষে দুপুর ১২টার দিকে অধিদফতরের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার পরীক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কমনরুমে আসেন।

এ সময় সেখানে দুটি বেসরকারি জাহাজের দু’জন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে জাহাজ রেজিস্ট্রেশন নিয়ে জরুরি কথা বলতে চান উল্লেখ করে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি কমনরুমে প্রবেশের অনুমতি চান। অনুমতি দিলে তিনি ভেতরে প্রবেশ করে মীর্জা সাইফুরের হাতে একটি চিরকুট দেন।

এতে লেখা ছিল- “চট্টগ্রামের ট্যাংকার জাহাজের মালিক ‘আবু সাহেব’ দুটি ট্যাংকার জাহাজের সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন করাবে’। এ সময় মীর্জা সাইফুর রহমান তাকে বলেন, এটা কোনো জরুরি বিষয় হল? এ ছাড়া এ নিয়ে কাগুজে চিরকুট লিখে দেয়ার কী আছে। জাহাজ সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন করার যে নিয়মকানুন আছে, সেভাবে তাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ যথাস্থানে আবেদন করতে হবে। এরপর লোকটি সেখান থেকে চলে যান।

কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে দুদকের সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বাধীন ফাঁদ টিম হুমমুড় করে প্রবেশ করেই তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। তাকে বলা হয়, তিনি বেরিয়ে যাওয়া লোকটির সঙ্গে ঘুষ লেনদেন করছিলেন। এমনকি প্রমাণ হিসেবে ওই কক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা জব্দ দেখানো হয়।

গ্রেফতারের পর তাকে আনা হয় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে। এরপর গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে মামলা করেন। চিরকুট রেখে যাওয়া অজ্ঞাত ব্যক্তিকে মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়। এজাহারে যার নাম লেখা হয় মো. মনিরুজ্জামান। মামলার বিবরণে বলা হয়, ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে দুদকের ফাঁদ টিমকে আগে থেকে গোপনে খবর দেন মামলার প্রধান সাক্ষী মনিরুজ্জামান।

মামলা শেষে ওইদিন আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয় মীর্জা সাইফুর রহমানকে।

কে এই মনিরুজ্জামান : তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রধান সাক্ষী মনিরুজ্জামান খাদিজাতুল কোবরা নামে একটি মালবাহী জাহাজের ম্যানেজার। তার পিতার নাম মো. হানিফ শেখ। জাহাজটিতে তিনি ম্যানেজার হিসেবে ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।

নথিপত্রে দেখা গেছে, জাহাজটির মালিক দু’জন। একজন সাতক্ষীরার দক্ষিণ পলাশপোলের রইজ উদ্দিনের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন এবং অপরজন খুলনার মুসলমান পাড়ার সৈয়দ রেজাউল করিমের ছেলে সৈয়দ আবু নাসের।

এই আবু নাসেরের আপন ভগিনীপতি এসএম নাজমুল হক। তিনি নৌপরিবহন অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী। যিনি ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল সেগুনবাগিচার একটি রেস্টুরেন্ট থেকে দুদকের একই ফাঁদ টিমের অভিযানে ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হন।

ওই ঘটনায় তিনি দুই দফায় জেলে ছিলেন। তার অভিযোগ- দুদককে ব্যবহার করে মীর্জা সাইফুর রহমান তাকে ধরিয়েছেন। জেল থেকে ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে তিনি নানা কৌশল বের করতে থাকেন। একপর্যায়ে দুদকের ফাঁদ টিমকে ব্যবহার করার সোর্স তিনি পেয়ে যান।

যার সূত্র ধরে তিনি মীর্জা সাইফুরকে দুদকের হাতে ধরিয়ে দিতে এসএম নাজমুলের স্ত্রীর বড় ভাইয়ের মালিকানাধীন জাহাজের ফিটনেস সনদ নেয়াকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী খাদিজাতুল কোবরা জাহাজের ম্যানেজার মনিরুজ্জামানকে পুরো ছক বুঝিয়ে দেয়া হয়।

তিনি বারবার খেই হারিয়ে ফেলেন। তার দেয়া বিভ্রান্তিকর তথ্যই প্রমাণ করে- এ ঘটনায় তাকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

যদিও ঘটনার রাজসাক্ষী মূল পরিকল্পনাকারী এসএম নাজমুল হক। কেননা, মুঠোফোনে কথোপকথনের রেকর্ডে তাকে দম্ভের সঙ্গে বলতে শোনা যায়, তিনিই তো দুদকের ফাঁদ টিমকে ব্যবহার করে মীর্জাকে ধরিয়ে দিয়েছেন।

এদিকে ২২ মার্চ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমার বাড়ি যশোরের লোহাগড়ায়।’ থাকেন কোথায় প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘নওয়াপাড়া।’ সেখানে তো আপনাকে পাওয়া যায়নি, এর জবাবে বলেন, ‘এখন আমি খুলনায় থাকি।’ তাহলে উত্তরা ও তুরাগের ঠিকানা দিয়ে দুদকে অভিযোগ করেছেন কীভাবে-জানতে চাইলে বলেন, ‘ওইখানে তো আমি আগে থাকতাম। ২০১৭ সাল পর্যন্ত থেকেছি।’

অভিযোগ তো করেছেন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, তাহলে সাবেক ঠিকানা কেন ব্যবহার করলেন? জবাবে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ন্যাশনাল আইডিতে দেয়া আছে তাই সাবেক ঠিকানা দেয়া হয়েছে।’ যে সিমটি (০১৮৯১৯৮৫৮২৩) দিয়ে কথা বলছেন সেটি টাঙ্গাইলের ঠিকানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন কেন?

এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তো সিম নিয়েছি ন্যাশনাল আইডি দিয়ে। এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’ লোহাগড়ার যে ঠিকানার কথা তিনি জানান, খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লোহাগড়া আসলে যশোর নয়, নড়াইল জেলায়।

আলামত নষ্ট ও পদে পদে মিথ্যাচার : ২ সেপ্টেম্বর মীর্জা সাইফুর রহমানকে গ্রেফতারের পর গত ৩ অক্টোবর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ২ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মনোজ কান্তি বড়ালকে আহ্বায়ক ও একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল ইসলামকে সদস্য করা হয়।

৮ জানুয়ারি এই কমিটি ১৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়। প্রতিবেদনে সার্বিক মন্তব্য ও সুপারিশে বলা হয়, ‘২ সেপ্টেম্বর দুদক মীর্জা সাইফুর রহমানকে গ্রেফতারের সময় সিসিটিভি চালু ছিল। ওই দিনের সকাল ১০টা ৫১ মিনিট থেকে ৩ মিনিট পর্যন্ত ফুটেজ পাওয়া গেছে। হার্ডডিস্ক সচল ছিল। ওইদিন বিকালে সিসিটিভির রেকর্ড অপশন ‘অফ’ পাওয়া গেছে।

সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ঘটনার দিন নৌপরিবহন অধিদফতরের সমন্বয় সভা চলাকালীন পরিচালক প্রশাসনের অফিস কক্ষে ঢুকে ডেটা ফরম্যাট করে সিসিটিভির ফুটেজ ডিলেট করা হয়েছে। এমনকি রেকর্ড অপশন বন্ধ করা হয়েছে। কে বা কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থা দ্বারা তদন্ত করা প্রয়োজন। এ অবস্থায় ২ সেপ্টেম্বর তারিখের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ না পাওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট (সিআইডি)-কে অনুরোধ করা যেতে পারে।’ সিআইডির এই তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানা গেছে।

শুধু এই এক ভিডিও ফুটেজই নয়, অভিযোগকারী মনিরুজ্জামান পদে পদে মিথ্যাচার করেছেন, যা তথ্যানুসন্ধানে বের হয়ে আসে। প্রথমত, এজাহারে মনিরুজ্জামানের ঢাকায় উত্তরার ৭নং সেক্টরের ৮৭নং প্লটে অবস্থিত বিএনএস সেন্টারে এমএস শিপিং লাইন্সের ঢাকা অফিস এবং পার্শ্ববর্তী তুরাগ থানাধীন নিশাত নগরের ধউর এলাকার ৪৯নং বাড়িতে বসবাসের ঠিকানা দেয়া হয়েছে।

কিন্তু দুটি ঠিকানার কোথাও তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আবার দুদক মীর্জা সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালতে যে চার্জশিট দিয়েছে তাতেও মনিরুজ্জামানের স্থায়ী ঠিকানা আড়াল করা হয়। চার্জশিটে যশোরের নওয়াপাড়া পৌর এলাকার একটি বর্তমান ঠিকানা দেয়া হয়।

সরেজমিন নওয়াপাড়ায় গিয়েও এই নামের কোনো ভাড়াটিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই মনিরুজ্জামান যে মোবাইল সিম (০১৮৯১৯৮৫৮২৩) ব্যবহার করেন তার নিবন্ধন ফরমে নাম লেখা আছে মনিরুজ্জামান। ঠিকানা দেয়া বাড়ি নং-৪৯, টাঙ্গাইল সদর। মীর্জা সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকের কাছে অভিযোগ করা হয় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর। আর এই সিমটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে ঘটনার ৪ দিন আগে অর্থাৎ ২৬ আগস্ট।

এদিকে খাদিজাতুল কোবরা নামক নৌযানটি সার্ভে করার জন্য নৌপরিবহন অধিদফতরে অনলাইনে গত বছরের ২৪ জুন স্বাভাবিক যে তথ্য আপলোড করতে হয় সেখানেও মনিরুজ্জামানের কোনো অস্তিত্ব নেই। মামলার এজাহার ও চার্জশিটে অভিযোগ করা হয়েছে- এমভি খাদিজাতুল কোবরা মালবাহী নৌযানটি সিমেন্ট নেয়ার জন্য যশোরের নওয়াপাড়া থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার সময় গত ৭ জুন ফতুল্লা এলাকায় এমভি বাবা-মায়ের দোয়া নামে অন্য একটি বালুবাহী নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা খায়।

এ সময় খাদিজাতুল কোবরা জাহাজের সম্মুখ ভাগের প্লেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসএম নাজমুল হকের স্ত্রীর বড় ভাই সৈয়দ আবু নাসেরের ঠিকানাও গোপন করা হয়। দ্বিতীয় মালিক হিসেবে একটি সাদা কাগজে নাম এবং বাবার নাম দেয়া হয় ঠিকই, কিন্তু স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা দেয়া হয়েছে ঢাকার সেগুনবাগিচা সংলগ্ন তোপখানা রোড।

দুর্ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারী মনিরুজ্জামান এজাহারের সঙ্গে মিল রেখে তথ্য দেন। দুর্ঘটনার বিষয়ে কোনো জিডি করেছিলেন কি না-জানতে চাইলে বলেন, ‘না, কোনো থানায় জিডি করা হয়নি।’ অথচ আইনে বলা আছে, ‘অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ধারা ৪৪(২) (৩) মোতাবেক প্রত্যেক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এবং যদি ইহা সম্ভব না হয়, দুর্ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উক্ত নৌযান বা নৌযানসমূহের যে কোনো ক্রু-সদস্য বা নৌযানসমূহের কোনো যাত্রী বা দুর্ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞাত যে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক নিকটবর্তী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দুর্ঘটনা সম্পর্কে রিপোর্ট করতে হবে। এ জাহাজের ক্ষেত্রে তা কিছুই করা হয়নি।’

ফোনালাপে গোমর ফাঁস : অনুসন্ধানের একপর্যায়ে হাতে দুটি অডিও রেকর্ড আসে। যা শোনার পর নিশ্চিত হওয়া যায়, মীর্জা সাইফুর রহমানকে গ্রেফতার করানোর বিষয়ে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এসএম নাজমুল হকসহ কয়েকজন সরাসরি জড়িত। তিনি টেলিফোনের অপর প্রান্তে থাকা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পিও শাহজাহান নামে এক কর্মকর্তাকে কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখে সরাসরি বলছেন, দুদকের ফাঁদ টিমের সহায়তা নিয়ে তিনিই মীর্জা সাইফুরকে ধরিয়ে দিয়েছেন।

পাঠকের জন্য ২১ মিনিটের ফোনালাপের গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন তুলে ধরা হল-

এসএম নাজমুল হক : ‘ক্যাপ্টেন গিয়াস, মঞ্জুর, ফখরুলসহ চারজন এক হয়ে মীর্জাকে ধরিয়েছি। কে কত টাকা দিয়েছে, কে কী কাজ করেছে-আমার কাছে তো সব রেকর্ড আছে। শাহজাহান, আমি স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড লোক। মীর্জাকে ধরার পেছনে আমি আছি, স্বীকার করি। চারজন মিলে ধরিয়েছি-এটা তো সত্যি কথা।

অস্বীকার করার কিছু নেই। আমাকে ধরার পেছনে মীর্জার ভূমিকা ছিল আশি ভাগ, আর ফখরুলের ভূমিকা ছিল বিশ ভাগ। ট্র্যাপ কেসে কাউরে ধরানো কোনো ব্যাপার না। চারজন সমানভাবে ফাইনেন্স করেছি। বিনা টাকায় কি দুদক আইসা ধইরা নিয়ে যায়?’ (সম্পূর্ণ অডিও শুনতে কিউআর কোড স্ক্যান করুন।)

চার্জশিটে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন : তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিদফতরের ওয়েবসাইটের অনলাইনে আপলোড করা ডকুমেন্ট অনুযায়ী এই নৌযানটি সার্ভে করার জন্য আবেদনকারী হলেন মো. রাজীব হোসেন। তিনি আর্থিক সুবিধা নিয়ে অন্য নৌযানের সার্ভের নথিপত্র অনলাইনে আপলোড করে থাকেন। অথচ এজাহারে মনিরুজ্জামানকে সার্ভের জন্য আবেদনকারী দেখানো হয়েছে।

সার্ভে করতে হলে অনলাইনে নৌযানটির মালিকানাসহ সব বৈধ কাগজপত্র আপলোড করতে হয়। আপলোড করা এই ডকুমেন্টের এক সেট কাছে এসেছে। এই নথিপত্রের গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ডক সার্টিফিকেট। দুর্ঘটনাকবলিত নৌযান মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান এই সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। যখন দুদক মামলাটি করে তখন এই ডক সার্টিফিকেট দেয়া হয় কেরানীগঞ্জের হোসেন ডকইয়ার্ড থেকে। আবার নৌপরিবহন অধিদফতরে সার্ভের জন্য আপলোডও করা হয় এই ডক সার্টিফিকেট।

যোগাযোগ করা হলে হোসেন ডকইয়ার্ডের মালিক মাসুদ হোসেন বলেন, “খাদিজাতুল কোবরা নামে কোনো নৌযান ‘হোসেন ডকইয়ার্ডে’ মেরামত করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের নামে প্যাড তৈরি করে ডক সার্টিফিকেটে আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। দুদক কর্মকর্তারাও তদন্তে এসে সবকিছু জেনে গেছেন।” অথচ নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে জাল করা এই ডক সার্টিফিকেটে বলা হয়, ‘এমভি খাদিজাতুল কোবরা নৌযানটি ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের ডকইয়ার্ডে উঠিয়ে জাহাজ কর্তৃপক্ষের মনোনীত প্রতিষ্ঠান দ্বারা যাবতীয় মেরামত, রঙের কাজ এবং ইঞ্জিনের সার্ভিসিং করা হয়েছে।’

এজাহারে বলা হয়েছে, ‘২০১৯ সালের ৭ জুন নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বাবা-মায়ের নামে একটি বালিবাহী নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা খেলে এমভি খাদিজাতুল কোবরার সম্মুখভাগের প্লেট গর্ত হয়ে ভেতরে চলে আসে।’ হোসেন ডকইয়ার্ডের নামে মেরামতের সনদ জাল করে অন্যান্য নথিপত্রের সঙ্গে গত বছরের ২৪ জুন নৌ অধিদফতরের অনলাইনে আপলোড করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ এই জালিয়াতির বিষয়টি এড়িয়ে যান।

সূত্র জানায়, হোসেন ডকইয়ার্ডের সনদ জালিয়াতির বিষয়টি দুদকের তদন্তে প্রকাশ হয়ে গেলে কেরানীগঞ্জের আরেকটি ডকইয়ার্ড (সাত্তার খান ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস) থেকে সনদ নেয়া হয়। ওই সনদের ওপর ভিত্তি করে চার্জশিট দিয়েছেন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম। এই সনদটি নেয়া ২০১৯ সালের ১৫ জুন।

জামিল বাতিলে জিডি : মীর্জা সাইফুর রহমান ২৭ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। ২৯ জানুয়ারি একটি মোবাইল নম্বর থেকে দুদকের দুই কর্মকর্তাসহ চারজনকে হত্যার হুমকি আসে। চারটি হুমকিই দেয়া হয় একদিনে। বিভিন্ন থানায় ৪টি জিডি করা হয়।

জিডিকারকরা হলেন : রাজধানীর রমনা থানায় দুদকের পরিচালক মো. আক্তার হোসেন, সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ, সাতক্ষীরা সদর থানায় জাহাজের একজন মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন ও খুলনা সদর থানায় অভিযোগকারী মো. মনিরুজ্জামান। চারটি জিডিতেই মীর্জা সাইফুর রহমানের বাল্যবন্ধু ইরফান আহমেদ লিটু পরিচয়ে হুমকি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ২ ফেব্রুয়ারি দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই জিডির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে মীর্জা সাইফুর রহমানের জামিন আদেশ বাতিল চেয়ে আবেদন করা হয়।

মোবাইলের কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, ০১৮৬০৯৪৮৩৯৫ নম্বরটি জনৈক কাওসারের নামে গত ২৫ নভেম্বর সিমটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়। ঠিকানা দেয়া হয় ধানমণ্ডির ৪নং সড়কের ২৫নং বাড়ি। পুলিশ তদন্তে নেমে ওই বাড়িতে গিয়ে এই নামের কাউকে খুঁজে পায়নি। তবে সিম রেজিস্ট্রেশন ফরমে কাওসারের জাতীয় পরিচয়পত্রের (নং ৩৭৫২৪৫৮২৭৭) সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে।

সেখানে দেখা গেছে, তার প্রকৃত নাম মেহেদুজ্জামান নুর ওরফে টিটু। জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৯৯৬। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানার নাটেশ্বর (পশ্চিম) তোরাব আলী মিজি বাড়ি গ্রামের হাবিব উল্লাহ ও আনোয়ারা বেগমের ছেলে তিনি। কললিস্টে দেখা গেছে, সিমটি শুধু ২৯ জানুয়ারিই ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশ এই যুবককে গ্রেফতার না করেই নামকাওয়াস্তে আদালতে প্রতিবেদন দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদুজ্জামান বলেন, তিনি ঝিগাতলায় একটি ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকানে চাকরি করেন। আলোচ্য সিমটি তার চুরি হয়েছে। জিডি করেছেন কি না-জানতে চাইলে বলেন, ‘না করিনি।’ সিমটির রেজিস্ট্রেশন ফরমে নিজের প্রকৃত নাম গোপন করে নাম কাওসার এবং ধানমণ্ডির অন্য একটি বাড়ির মিথ্যা ঠিকানা কেন দিলেন-প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর না দিয়েই মুখ লুকানোর চেষ্টা করেন এই মেহেদুজ্জামান।

পুলিশ আপনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল কি না-জানতে চাইলে বলেন, ‘না, সাতক্ষীরা, খুলনা ও ঢাকার কোনো পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আমার কথা হয়নি।’ অথচ চারটি জিডির প্রতিবেদনে কোথাও মেহেদুজ্জামানের নাম নেয়া হয়নি। বিষয়টি জানা সত্ত্বেও পুলিশ গোপন করে। যা শুধু রহস্যজনক নয়, উদ্দেশ্যমূলক বলে প্রতীয়মান হয়।

অভিযোগের বিষয়ে ফোনে কোনো বলতে রাজি হননি এসএম নাজমুল হক। তিনি বলেন, ‘যা প্রশ্ন মেইল করেন।’ এরপর ২৫ মার্চ লিখিত ৫টি প্রশ্ন মেইল করা হয়। গত আড়াই মাসেও এর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

তবে দুদকের সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘ট্র্যাপ কেসে যাদের গ্রেফতার করা হয়, তারা নিজেদের রক্ষায় উল্টো অভিযোগ করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। ট্র্যাপ কেস বাস্তবায়ন করতে উচ্চপর্যায়ের অনুমোদন নিতে হয়।

এই সিদ্ধান্তগুলো জানাই যায় না। একজন পরিচালকের তত্ত্বাবধানে ট্র্যাপ হয়। আমাদের মতো কর্মকর্তার কি ক্ষমতা আছে, এটা বাস্তবায়ন করার, বলেন?’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব নথিপত্র যদি তদন্ত করতে যাই তাহলে তো আর ট্র্যাপ কেস বাস্তবায়ন করা যায় না।

সেগুলো তদন্ত পর্যায়ে থাকে।’ মোবাইলে হুমকির বিষয়ে বলেন, ‘আমরা হুমকি পেয়েই থানায় জিডি করেছি। আমরা ভুক্তভোগী। বিধি মোতাবেক যা করা দরকার আমরা কোর্টকে জানিয়েছি। এই জিডির তদন্ত করেছে। এর বেশি আমি কিছুই জানি না।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 − 3 =