শতবর্ষের শেখ মুজিব

0
492

অপরাধ বিচিত্রা: আমার নেতা, তোমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’-লাখো মানুষের কন্ঠে ধ্বনিত এই শ্লোগান শোনার অভিজ্ঞতা কখনও ভোলার নয়। মানুষের ঢল ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রমনা রেসকোর্স পর্যন্ত। দীর্ঘ নয় মাসেরও বেশি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীদশায় কাটে তাঁর। মুক্তি পেয়ে লন্ডন আর নতুন দিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন তিনি। বাংলার মানুষের অবিসংবাদী এই নেতাকে বরণ করে নেন আপামর জনসাধারণ আনন্দের অশ্রæ বইয়ে দিয়ে। একটি খোলা ট্রাকে মাল্যশোভিত রাষ্ট্রনেতা! তাঁর পাশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আরও অনেকে। এই ট্রাকটির রেসকোর্সে পৌঁছতে সময় লাগে আড়াই ঘন্টার মতো। স্বাধীন বাংলাদেশের জনক রেসকোর্স ময়দানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান লক্ষ লক্ষ মানুষকে উদ্দেশ্য করে ভাষণ দিলেন।

সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত! বন্দী জীবনের সকল অনিশ্চয়তার মাঝেও এই মাহেন্দ্র্যক্ষণের জন্যই প্রতীক্ষা করছিলেন তিনি। আবেগঘন কন্ঠে বললেন: ‘‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।’’ আমরা যারা সেদিনের এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, আমাদের চোখেও অশ্রæধারা।

এ অশ্রæ বিয়োগের নয়, জাতির জনককে ফিরে পাওয়ার আনন্দে সিক্ত অশ্রæ। দৃঢতার সঙ্গে সেদিন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন যে বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশ হিসেবেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নাই।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বসভায় তার স্থায়ী আসন অধিকার করে নিয়েছে। পথটি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ঈপ্সিত স্বাধীনতাও অর্জিত হয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চালিত এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, লাখ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। বাঙালি সৈনিকদের সংঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন সাধারণ মানুষ  কৃষক, শ্রমিক, কর্মজীবী মানুষ। তরুণরা হাতে তুলে নেয় হাতিয়ার, এগিয়ে আসেন বহু নারী।

মুক্তিযোদ্ধারা দখলিত এলাকায় গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পর্যুদস্ত করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের। নয় মাস স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে মুজিবনগরে গঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। এই প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অসীম ধৈর্য আর যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেন তাজউদ্দিন আহমদ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই প্রবাসী সরকারকে দেন সব রকমের সাহায্য আর সমর্থন। আশ্রয় দেন পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা এক কোটি শরণার্থীকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ও মুক্তির এই লড়াই প্রত্যক্ষ করতে পারেননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দীদশার কারণে।

কিন্তু গোটা যুদ্ধ জুড়েই ছিল যেন তাঁর উপস্থিতি। তাঁরই নামে চালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ, স্বশরীরে উপস্থিত না থেকেও তিনিই ছিলেন ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সর্বসম্মত নেতা। তাঁর মুক্তির জন্য ইন্দিরা গান্ধী ছুটে বেড়িয়েছেন এক দেশ থেকে আর এক দেশে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন একের পর এক বাঙালি ক‚টনীতিক, আমলা। পালিয়ে এসে যুক্ত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের কাজে। পাকিস্তানে আটক বাঙালি সেনা অফিসারদের কেউ কেউ প্রাণের তোয়াক্কা না করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পৌঁছে গেছেন মুজিবনগরে। যোগ দিয়েছেন মুক্তি বাহিনীতে। স্বাধীনতার যে ডাকে আমরা সাড়া দিয়েছিলাম সেই ডাকটি এসেছিলো যাঁর কাছ থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × one =