মেয়র তাপসের নির্দেশেও দখলমুক্ত হচ্ছে না শাহাবুদ্দিন সিন্ডিকেটের অবৈধ দোকানপাট

0
610

স্টাফ রিপোর্টার: যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিন-বাপ্পি-রনি সিন্ডিকেট গুলিস্তানের ৪টি মার্কেট দখলে নিয়ে কয়েক হাজার অবৈধ দোকানপাট গড়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বেপরোয়া গতিতে চাঁদাবাজি চালিয়ে আসছে বলে ব্যবসায়ীদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এসব বিষয়ে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) সহ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ও একই বিভাগের ডিবির ডিসির কাছে অভিযোগ জমা দিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। সম্প্রতি শাহাবুদ্দিন সিন্ডিকেটর এসব অপকর্মের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিষ্টার শেখ ফজলে নুর তাপস মার্কেটগুলো অবৈধ দখলদার মুক্ত করার কঠোর ঘোষনা দিলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীরা তাদের অভিযোগে বলেন, ঢাকা দক্ষিণের২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন প্রথমে জোরপূর্বক দখল করেন সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট। এই মার্কেট পরিচালনার মূল কমিটিকে বাদ দিয়ে শাহাবুদ্দিন নিজেকে সভাপতি ঘোষণা করে মার্কেটের বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধভাবে ৬৫৭টি দোকান নির্মাণ করে তা বিক্রি মাধ্যমে প্রায় ৮০কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর দখল করেন বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্স ক ও খ ইউনিট। এখান থেকে ৫৯০টি দোকান বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৭০ কোটি টাকা। গুলিস্তান পুরান বাজার মার্কেটের পার্কিং স্থানে প্রায় ৩০০ অবৈধ দোকান নির্মাণ করে বিক্রির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন আরো ৩০ কোটি টাকা। এতো সবের পরেও ব্যবসায়ী দোকান মালিকদের নিকট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন নিয়মিত মাসিক চাঁদা।

অনসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের খোলা স্পেস, বারান্দা, করিডর, টয়লেট, সিড়ির জায়গা, মসজিদ, ছাদ, জেনারেটর রুম ও পার্কিংয়ের জায়গায় নির্মান করা হয়েছে শত শত দোকানঘর। মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্কিংয়ের জায়গায় কয়েকশ’ দোকান বানিয়ে সেগুলোকে বিক্রি করেছে ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিন, আহাদ বাপ্পি, রনি, জাকেরর ফিরোজ মিয়া, নোয়াখালী ফিরোজ সিন্ডিকেট। সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটটি ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের ৩৪নং ওয়ার্ডভুক্ত। অথচ মার্কেটটি দখলে নিয়েছেন ২০নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন ওরফে হাজী শাহাবুদ্দিন। অবিশ^াস্য হলেও সত্যি শাহাবুদ্দিনের যুবলীগ সভাপতি হওয়ার পেছনে রয়েছে চমকপ্রদ কিছু তথ্য।

সেনা সমর্থিত মঈন-ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধাক সরকারের আমলে গুলিস্তানের ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন এই শাহাবুদ্দিন। সেই সময় শাহাবুদ্দিন ছিলেন ইউনিট যুবদলের নেতা। তৎকালীন গুলিস্তানের বিএনপির সহ-সভাপতি মোজাম্মেল হক মঞ্জুরের আর্শীবাদেই শাহাবুদ্দিনের বেড়ে উঠা। তবে ক্ষমতার পালাবদলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে হাতে পেয়ে যান আলাদীনের চেরাগ। সরকারী দলে নাম লিখিয়ে সখ্যতা গড়ে তুলেন ক্যাসিনোর গডফাদার সম্রাটের সঙ্গে। আর তার মাধ্যমেই বাগিয়ে নেন ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতির পদ। সভাপতির পদ পেয়ে প্রথমেই নিয়ন্ত্রনে নেন গুলিস্তান হকার্স মার্কেট।

গুলিস্তানে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রের পরিচালক আলী আহম্মেদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে ক্যাসিনো বোর্ড থেকে প্রতি রাতে মানতি নিতেন ৩০ হাজার টাকা। পালাক্রমে গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, আদর্শ মহানগর মার্কেটসহ আশপাশের অধিকাংশ মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মার্কেটগুলোতে অবৈধ দোকান নির্মান করে তা বিক্রি সহ চাঁদাবাজির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। আর সরকারের দুর্নীতি বিরোধী শুদ্ধি অভিযান চলাকালীন শাহাবুদ্দিন সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন নিশ্চুপ থাকলেও এখন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন চাঁদা আদায়ে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা অভিযোগ পত্রে বলা হয়, যুবলীগের প্রভাব খাটিয়ে শাহাবুদ্দিন এখন শত কোটি টাকার মালিক। বর্তমানে তার নিয়ন্ত্রণে গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া ও বঙ্গবাজারের পাঁচটি মার্কেট। গুলিস্তানের ব্যবসায়ীদের কাছে যুুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিন এখন এক আতঙ্কের নাম। বিভিন্ন মার্কেটের অবৈধ জায়গায় দোকান স্থাপন করে একই দোকান ৩/৪ জনের কাছে বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। শাহাবুদ্দিন অত্যান্ত ক্ষমতাশালী হওয়ায় কেউ তার কাছে টাকা ফেরত চাইতেই সাহস পান না। কারন শাহাবুদ্দিনের অন্যতম প্রধান সহযোগী হলেন ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আহাদ বাপ্পি, রনি, জাকেরের ফিরোজ মিয়া, নোয়াখালীর ফিরোজ প্রমুখ। আর এদেরকে শেল্টার দিচ্ছেন ক্যাসিনোকালীন শুদ্ধি অভিযানের অভিযুক্ত মাইনুদ্দিন রানা ও রেজাউল করিম রেজা।

সুত্র জানায়, গুলিস্তানের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ম মেনে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রেখে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটটি নির্মাণ করা হলেও চাঁদাবাজ শাহাবুদ্দিনের দখল দারিত্বের কারণে মার্কেটটির সেই জৌলুস হারিয়ে গেছে। মার্কেটের ১২০৯টি বৈধ দোকান থাকলেও শাহাবুদ্দিন সেখানে আরও ৭ শতাধিক অবৈধ দোকান নির্মান করেছেন। দোকান প্রতি ১০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়া এসব দোকান নির্মাণ করে শাহাবুদ্দিন হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৮০ কোটি টাকা। দোকান বিক্রির এ টাকার ভাগ ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাসহ সিটি করপোরেশনের একাধিক অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে গেলেও সিটি করপোরেশনের রাজস্ব খাতে জমা পড়েনি এক কানাকড়ি।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে দিয়ে দেখা গেছে, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটটি চারতলা হলেও সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে অনুমোদন ছাড়াই আরও একতলা নির্মাণ করেন শাহাবুদ্দিন। এ ছাড়া মার্কেটের প্রতিটি ফ্লোরের বিভিন্ন কমন স্পেস, ফ্লোরপ্রতি দুটি করে টয়লেট, ওজু করার স্থান ছিল। কিন্তু এসব ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে দোকানঘর। ব্যবসার স্বার্থে মার্কেটটির ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করেন ১২টি এস্কেলেটর (চলন্ত সিড়ি)। শাহাবুদ্দিন এসব সিঁড়ি ভেঙে ভাঙ্গাড়ির দোকানে বিক্রি করে দেন। বেসমেন্টের জেনারেটর রুমটিও দোকান বানিয়ে বিক্রি করে দেন। ওযুখানা, মসজিদ ঘর ও লিফটের জায়গায় নির্মান করেন খাবার হোটেল।

গার্ডরুম, বৈদ্যুতিক সুইচ রুম, প্রতি তলায় সিঁড়ির পাশে ও নিচেও দোকান তৈরি করেন। বেসমেন্টের ওয়াটার রিজার্ভের স্থানেও তৈরি করেন দোকান ঘর। অবৈধভাবে সব মিলিয়ে প্রায় ৭ শতাধিক দোকান নির্মাণ করেন। আর এসব দোকান সিটি করপোরেশন কর্তৃক মালিকদের স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে মেয়র সাঈদ খোকনের নামে দোকান প্রতি ৬ লাখ টাকা হারে অন্তত ৩৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা আদায় করেন। কিন্তু মার্কেটের নিয়মিত দোকান মালিকেরা ওই সময় সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করেনি।

এদিকে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট ছাড়াও গুলিস্তান মহানগর মার্কেট, বঙ্গবাজার মার্কেট ও আদর্শ গুলিস্তান মার্কেটেরও অলিখিত নিয়ন্ত্রক এই যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিন। প্রতি মাসে তিনি এসব মার্কেটের দোকান থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা উত্তোলন করেন। এ ছাড়া মার্কেটের বিভিন্ন ফাঁকা স্থানেও দোকান বানিয়ে তা বিক্রি করেন। সিটি করপোরেশন এসব দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যান মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে। দুর্ধর্ষ এই শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের ট্রান্সফরমারও বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

সুত্র জানায়, শাহাবুদ্দিন অভিনব কৌশলে এসব মার্কেট দখল করে তার সিন্ডিকেটের লোকজন দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে মুল কমিটির উপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে বিতারিত করেন। পরে নিজের অনুগতদের নামে দোকান বরাদ্দ দিয়ে নিজেই মার্কেট পরিচালনা করেন। ২৫ জানুয়ারি-২০২০ সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট ব্যবসায়ীদের উপর হামলা চালায় শাহাবুদ্দিন ও তার ক্যাডার বাহিনী। এতে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাইনুল ইসলাম মামুন সহ অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ী গুরুতর আহত হয়।

এব্যাপারে গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আবু বক্কার সিদ্দিক বলেন, ২০নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিনের নির্দেশে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। শাহাবুদ্দিন সহ দক্ষিণ সটি কর্পোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আহাদ বাপ্পি ও রনি সহ ৬০/৭০ জন ক্যাডার হঠাৎ সমিতির অফিসে হামলা চালায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিন একজন দখলবাজ। সে মার্কেট দখল করতেই এই হামলা চালিয়েছে।

ভুক্তভোগীরা আরো জানান, শাহাবুদ্দিন ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা গত এক দশকে এই মার্কেটগুলো থেকে অবৈধ উপায়ে শতশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শাহাবুদ্দিন বর্তমানে তানাকা টাওয়ারের নিজ ফ্লাটে বসবাস করেন। তাছাড়া সেগুন বাগিচাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে তার আরও একাধিক ফ্লাট রয়েছে। শুদ্ধি অভিযানের সময় শাহাবুদ্দিন এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও এখন আবার সক্রিয় হয়ে পুনরায় অপকর্ম শুরু করে দিয়েছে। ভুক্তভোগীরা শাহাবুদ্দিন চক্রের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নগর পিতা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

1 × 3 =