কাউন্সিলর মতিন সাউদের শালিস বানিজ্য

0
571

মো: আহসানউল্লাহ হাসান: বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে-সরিষার মধ্যে ভুত থাকিলে ভুত তাড়াবে কে? কথাটিকে শতভাগ সত্য প্রমানিত করলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৬৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল মতিন সাউদ। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হলে প্রথমেই ছুটে যায় স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যান বা জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে পরবর্তীতে থানা পুলিশের কাছে একটু ন্যায় বিচার পাওয়ার আশায়। কিন্তু ন্যায় বিচার তো দুরের কথা বরং মানুষের অসহায়ত্বকে পুজি করে এই শ্রেণীর মানুষ গুলো নিজেদের সুবিধাটাকেই দেখে সবার আগে। কে বাঁচল আর কে মরলো, সেই খবর নেয়ার সময় তাদের থাকেনা। তাদের কাছে অপরাধীরা পায় পুরষ্কার আর ক্ষতিগ্রস্থরা ব্যক্তি পায় তিরষ্কার। কাউন্সিলর মতিনের শালিস বানিজ্যে সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। মাদকসেবী সিন্ডিকেটের হামলায় আহত রংমিস্ত্রি জাহাঙ্গীরের সাথে যা ঘটেছে তা নিয়েই এবারের প্রতিবেদন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ডেমরা থানাধীন ডগাইর নতুনপাড়া ভুইয়া মসজিদ সংলগ্ন আব্দুল হক বেপারীর ছেলে মো: জাহাঙ্গীর আলম। পেশায় একজন রং মিস্ত্রি। প্রতিদিনের মতো কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে গত ২৭ আগষ্ট-২০২০ইং তারিখ রাত ১১ টার সময় একই এলাকার মো: আলী মিয়ার ছেলে ইয়াবাখোর সোহাগ হোসেন তাকে অন্যত্র থেকে ইয়াবা এনে দিতে বলে। সোহাগের এই বেআইনি কাজ না করে জাহাঙ্গীর বাসা চলে যায়। এতে সোহাগ চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছুক্ষন পরেই তার মাদক সেকনকারী সিন্ডিকেটের মুল হোতা সৌদি প্রবাসী মোতালেব, মো: রাসেল ভুইয়া, আব্দুস ছোবহান সাথে শলাপরামর্শ করে জাহাঙ্গীরকে ঘর থেকে ডেকে এনে প্রচন্ড মারধর করে।

আহত অবস্থায় জাহাঙ্গীর আইনী সহায়তা পাওয়ার জন্য থানায় গেলে থানার এসআই রেজাউল করিম পান্নু ঘটনাস্থলে তদন্তে আসে। কিন্তু এসআই রেজাউল করিম পান্নুর সামনেই আসামী সোহাগের ভাই নাঈম হোসেন পুনরায় জাহাঙ্গীরকে গলা টিপে শ^াসরোধ করে মারার চেষ্টা করে, কেন সে পুলিশ নিয়ে এসেছে। এসময় এসআই পান্নু নাঈমকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় এবং জাহাঙ্গীরকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন। এদিকে নাঈমকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পরে সৌদিপ্রবাসী মোতালেব মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ঐ রাতে তাকে ছাড়িয়ে আনে এবং ৩০ আগষ্ট ঘটনার বিচার হবে বলে এসআই পান্নুকে আশ^স্ত করে। কিন্তু বিচারে নামে চলে প্রহসন। ভুইয়া মসজিদ এলাকার হর্তাকর্তা বলে খ্যাত আব্দুস সোবহানের নির্দেশে উল্টো জাহাঙ্গীরকেই চোর অপবাদ দিয়ে এলাকায় প্রচার করতে থাকে।

এঘটনায় জাহাঙ্গীর বাদী হয়ে সোহাগ, রাসেল ভুইয়া ও আব্দুস সোবহানে নামে একটি জিডি করে। জিডি নং-১১৭২। এতে তার উপর নির্যাতনে মাত্রা আরো বেড়ে যায়। এসআই পান্নুকে জানালে তিনিও তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। অতপর ১০সেপ্টেম্বর-২০২০ জাহাঙ্গীর এঘটনার লিখিত বর্নণা দিয়ে জেলা প্রশাসক ঢাকা, ডেপুটি কমিশনার ওয়ারী সার্কেল, ওসি ডেমরা থানা, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মসজিদ কমিটির সভাপতি সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের অবগত করেন। এঘটনার দুইদিন পরে কাউন্সিলর আব্দুল মতিন সাউদ উভয় পক্ষকে নিয়ে বিচার করেন। তবে বিচারের আগেই তিনি জাহাঙ্গীরকে হুমকি ধামকি দিয়ে বলেন, বেশী বাড়াবাড়ি করলে পুলিশ দিয়া ধরিয়ে দেব।

অতপর আপোষনামা নামের সাদাকাগজে জাহাঙ্গীরের টিপসই সহ স্বাক্ষর করিয়ে রাখেন। পাশাপাশি জাহাঙ্গীকে কয়েকটি প্রশ্ন করে তাহা আবার মোবাইলে ভিডিও ধারনও করে রাখেন। প্রশ্নগুলো ছিলো এমন-জাহাঙ্গীর তোমার আর কোন অভিযোগ আছে-জাহাঙ্গীর উত্তর দেয় না, তোমারে কেউ ভয়ভীতি দেখাইছে-না, ইত্যাদি। এই ভিডিও এখন এসআই পান্নু সহ অনেকের কাছেই সংরক্ষিত আছে। তবে কাউন্সিলর মতিন সাউদের এমন বিচার দেখে স্থানীয়দের অনেকেই হতবাক। যে কোন বিচারেই অপরাধী শাস্তি পাবে আর ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি পাবে ক্ষতিপুরন এমনটাই নিয়ম। কিন্তু কাউন্সিলর মতিন সাউদের দরবারে ঘটেছে অন্য কিছু। ক্ষতিগ্রস্থ জাহাঙ্গীরকে কোন প্রকার ক্ষতিপুরন দেয়া হয়নি।

আবার সোহাগ সিন্ডিকেটকেও দোষী সাব্যস্ত করে কোন শাস্তি প্রদান করা হয়নি। বিচারের সময় এটা প্রচারিত হয়েছে যে, থানা পুলিশকেই তো টাকা দিয়েছি, জাহাঙ্গীরকে আবার কি দিবো। জাহাঙ্গীরের নিকট থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর ও টিপসই নিয়ে আপোষনামা বানানো হয়েছে। আর কাউন্সিলর স্বাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষরিত এই আপোষনামার কপি এখন এসআই পান্নুর কাছে সংরক্ষিত আছে। যাহা জিডি বাতিল করার কাজে লাগাবেন বলে জানা গেছে। তবে জিডিতে সোহাগ, রাসেল ভুইয়া ও আব্দুস ছোবহানকে আসামী করা হলেও আপোষনামায় স্বাক্ষর করেছে শুধুমাত্র সোহাগ হোসেন। এমন বিচার সম্পর্কে জানতে চাইলে কাউন্সিলর মতিন সাউদ বলেন, জেনে শুনে বুঝেই বিচার করেছি।

আমার বিচার পছন্দ না হলে অন্য কারোর কাছে যেতে পারেন। প্রতিদিন আমাকে দুইতিনটে বিচার করতে হয়। আপনে আমার অফিসে আইসেন চায়ের দাওয়াত রইল। স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বকশী বলেন, কাউন্সিলরের এমন বিচারে আমি হতাশ। জাহাঙ্গীর ক্ষতিগ্রস্থ, তাকে কিছুনা কিছু ক্ষতিপুরন দেয়া উচিত ছিলো। ডেমরা থানার এসআই রেজাউল করিম পান্নু বলেন, জাহাঙ্গীর ছেলে হিসেবে খুবই ভালো। ছেলেটার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। কিন্তু সে তো আসামীদের সাথে আপোষ করে ফেলেছে। তাই আমি কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি।

আসামী রাসেল ভুইয়া বলেন, জাহাঙ্গীর মাইর খাইছে, কাউন্সিলরের সামনে প্রমান তা করতে পারে নাই। তাহলে ঢাকা মেডিকেল থেকে চিকিৎসা নিয়েছে কেন? এমন প্রশ্নে রাসেলের উত্তর-টাকা দিলে এমন অনেক মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়া যায়। কে এই সোহাগ, রাসেল ভুইয়া, আব্দুস ছোবহান, সৌদি প্রবাসী মোতলেব? এলাকায় তারা কেমন প্রভাব বিস্তার করেছে, কেন অপরাধ করার পরেও তাদের বিচার হয় না, কাউন্সিলরই বা কেন তাদের পক্ষ অবলম্বন করলো এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আসছে আগামী পর্ব।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen − seven =