প্রশাসনের নীরব ভূমিকায়! ধরাছোঁয়ার বাহিরে রয়েছে সার চোরেরা

0
695

রাশেদুল ইসলাম: ফটিকছড়ির বক্তপুর ইউনিয়নে মৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর জাল করে গত দশ বছর ধরে কোটি কোটি টাকার সার উত্তোলনের অভিযোগে ভুক্তভোগী মোহাম্মদ ইসহাক মিয়াকে প্রধান আসামী করা হলেও অভিযুক্ত কারো বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মামলায় অন্য আসামিরা ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত থাকলেও এখনো গ্রেপ্তার হয়নি তারা। আর আবু শাহাদাত সরাসরি জড়িত থাকলেও মামলায় আসামি করা হয়নি তাকে। এমনকি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গাফিলাতি থাকলেও সে বিষয়ে কোন নজর নেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের অফিসার ইনচার্জ জানান, মামলার তদন্ত চলছে। আসামিরা আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা গেলে গ্রেপ্তার করা হবে। এর আগে এ বিষয়ের উপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে অপরাধ বিচিত্রা। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর জাল করে গত দশ বছর ধরে কোটি কোটি টাকার সার উত্তোলন এবং পাচার করেছে একটি চক্র। এমন একটি অভিযোগ এনে গত অক্টোবরের ১০ তারিখ দুর্নীতি দমন কমিশন, জেলা প্রশাসন এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরাবরে চিঠি দিয়েছেন সেই মৃত ডিলারের ছেলে মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া। অভিযোগে এ ঘটনার সাথে জড়িত তিনজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন তিনি। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ফটিকছড়ির বক্তপুর ইউনিয়নের সার ডিলার হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন পটিয়ার ভাটিখাইন গ্রামের মৃত কালা মিয়ার পুত্র আলহাজ্ব আবদুল ছবুর। বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) তালিকাভুক্ত সার ডিলার হিসেবে তিনি রাষ্ট্রায়াত্ত সার কারখানাগুলো থেকে প্রতি মাসে সার উত্তোলন করে ফটিকছড়ির কৃষকদের নিকট বিক্রি করতেন। গত ২০১১ সালের ১৮ মার্চ আলহাজ্ব আবদুল ছবুর মারা যান। কিন্তু তিনি যে মাসে মারা গেছেন ওই মাস থেকে শুরু করে গত দশ বছর ধরে প্রতি মাসেই তার স্বাক্ষর জাল করে সার উত্তোলন করা হয়েছে।

সার উত্তোলন করে তা এলাকায় বিক্রির ব্যাপারে সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের দেখভালের নিয়ম থাকলেও আবদুল ছবুরের অনুপস্থিতিতেই সব কাগজপত্রই গত দশ বছর ধরে স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি মারা গেলেও তার নামের লাইসেন্সকে জীবিত রেখে স্বাক্ষর জাল করে অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকার সার উত্তোলন করা হয়েছে। এসব সারের একটি বড় অংশ মায়ানমারে পাচারের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া লিখিত অভিযোগে আবু শাহাদাত, মোহাম্মদ আজগর বৈদ্য এবং মনির আহমদ নামের তিন ব্যক্তিকে বিবাদী করা হয়।

লিখিত অভিযোগে ইসহাক মিয়া বলেন, বাবার মৃত্যুর পর আবু শাহাদাত তাকে জানান মৃত ব্যক্তির নামে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। তাই তিনি অন্য ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। অথচ তার বাবার লাইসেন্সের বিপরীতে প্রতি বছরই অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার সারের ব্যবসা হয়েছে। আর বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে প্রান্তিক অঞ্চলের কৃষকরা। অভিযোগের মাধ্যমে তিনি ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিচার দাবি করেন। অভিযোগের পর দেশ ও কৃষকের শত্রুদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে।

আর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবে,এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু মৃত ডিলারের ছেলে মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া অভিযোগ করে ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। যা রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পুরো চট্টগ্রামে। মৃত বাবার স্বাক্ষর জাল করে কুচক্রী মহল ১০ বছর ধরে সার উত্তোলন করার ঘটনায় প্রতিকার চাওয়ায় উল্টো মামলার আসামী হয়েছেন তিনি। থানা কৃষি কর্মকর্তা লিটন দেবনাথ বাদী হয়ে গত ২১ অক্টোবর থানায় মামলাটি রুজু করেন।

এতে ঘটনার মূল হোতাদের বাঁচানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলছেন,সার উত্তোলনের সময় ডিলার সরাসরি উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও দশ বছর ধরে কৃষকের কোটি সার কিভাবে অন্যের হাতে তুলে দিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা, তার উত্তর সবারই জানা আছে। নিজেদের দোষ ধামাচাপা দেয়ার বৃথা চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন সরকারি কর্তারা। আর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন থানাকে। আলোচিত এ ঘটনার যাচাই বাছাই ছাড়া সরাসরি মামলা রুজু করায় প্রশ্নবিদ্ধ প্রশাসনও। জানা যায়, সারের ডিলার এম এ সবুর এন্ড ব্রাদার্সের মালিক আলহাজ্ব আবদুল ছবুর মারা যান ২০১১ সালে।

কিন্তু আবদুল ছবুরের স্বাক্ষর জাল করে সংঘবদ্ধ চক্রটি গত দশ বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কারখানাগুলো থেকে সার উত্তোলন করে। ফটিকছড়ির বক্তপুর ইউনিয়নের ডিলার হিসেবে এই লাইসেন্সের আওতায় সার তোলা হলেও আবদুল ছবুরের পরিবার পরিজন কিছুই জানেন না। কারণ পটিয়া থানা সদরে প্লাস্টিক ক্রোকারিজের ব্যবসা করা মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া সার ব্যবসার সাথেই জড়িত নন। তার বড় ভাইও মারা গেছেন। অথচ ফটিকছড়ির বক্তপুর ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত ডিলার হিসেবে তার পিতার লাইসেন্সে বছরের পর বছর সার উত্তোলন এবং বিক্রি হয়েছে।

ফটিকছড়ির ডিলার হলেও আবদুল ছবুর পটিয়ার ভাটিখাইন গ্রামের মৃত কালা মিয়ার ছেলে। বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) তালিকাভুক্ত সার ডিলার হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সার কারখানাগুলো থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১০ টন পর্যন্ত সার উত্তোলনের রেকর্ড রয়েছে এই লাইসেন্সের বিপরীতে। মৃত বাবার লাইসেন্সের বিপরীতে এক বছরে অন্তত এক কোটি টাকার সার উত্তোলন এবং বিক্রি হলেও মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া পটিয়া থানা সদরের প্যারাগন ক্রোকারিজ নামের একটি দোকানের সামান্য একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী। অথচ ফটিকছড়ি থানায় এই ভুক্তভোগী মোহাম্মদ ইসহাক মিয়াকেই প্রধান আসামি করে মামলা রুজু করা হয়েছে।

একই মামলায় আলী আজগরকে এম এ সবুর এন্ড ব্রাদার্সের ম্যানেজার হিসেবে উল্লেখ করে এবং ফটিকছড়ির নানুপুরের সার ব্যবসায়ী হারুন স্টোরের মালিক মোহাম্মদ হারুনকে আসামি করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর অনুসন্ধানে নামে অপরাধ বিচিত্রা। অনুসন্ধান বলছে, মৃত ডিলারের ছেলে ইছহাক মিয়া আবু শাহাদাত নামে যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে সার উত্তোলনের অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়েছেন সেই শাহাদাত তার আপন চাচাতো ভাই। ভুক্তভোগী ইছাহাকের বাবা মৃত এম এ সবুরের মতো আবু শাহাদাতের বাবা মৃত নবী সওদাগরও সারের ডিলার ছিলেন।

মৃত এম এ সবুরের লাইসেন্স ছিল ফটিকছড়ির আর মৃত নবী সওদাগরের ছিল পটিয়াতে নবী এন্ড সন্স নামে প্রতিষ্ঠানে। নবী সওদাগরের মৃত্যুর পর তথ্য গোপন রেখে অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর তার ছেলে আবু শাহাদাত সার উত্তোলনের পর পাচার করে মায়ানমারে। পরে তার আপন ভাই সেলিম নবী বিষয়টি জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে শাহাদাতের অবৈধভাবে সার উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। এটাতো ছিল পটিয়ার ঘটনা। সেটাও মৃত বাবার প্রতিষ্ঠান নিয়ে জালিয়াতি। এ জালিয়াতির অভিজ্ঞতা তিনি রপ্ত করেন ফটিকছড়িতে তার চাচা এম এ সবুরের স্বাক্ষর জাতিয়াতির মাধ্যমে সার উত্তোলন করে। অসাধু কর্তারা তাকে সুযোগটি সৃষ্টি করে দেন।

এম এ সবুর মারা যাওয়ার পর এই শাহাদাতই ভুক্তভোগী ইসহাককে জানিয়েছিল মৃত ব্যক্তির ডিলারশীপ বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর এম এ সবুরের স্বাক্ষর জাল করে তার পরিবারকে ঠকিয়ে সার উত্তোলন করে শাহাদাত আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় তা ভারত ও মায়ানমারে পাচার করে। নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেই মামলা করে কর্তৃপক্ষ। মামলার দ্বিতীয় আসামী আলী আজগরকে মেসার্স এম এ সবুর এন্ড ব্রাদার্স এর ম্যানেজার হিসেবে উল্লেখ করা হলেও সূত্র জানায় তিনি অভিযুক্ত আবু শাহাদাতের প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। তিনি মধ্যবর্তী হয়ে কাজ করতেন।

আর এ বার্মা আজগরের নামে ভুক্তভোগী ইসহাকও অভিযোগ করেছিল। কিন্তু মূল হোতাকে বাঁচানোর জন্য অভিযুক্ত আজগরের সাথে ভুক্তভোগী ইসহাককে আসামী করা হয়। মামলার আরেকজন আসামী হারুন। তিনি ফটিকছড়ি হারুণ স্টোরে অবৈধভাবে উত্তোলনকৃত সার মজুত রাখতেন। তিনি পুরো ঘটনার রাজস্বাক্ষী হওয়ায় তাকেও আসামী করা হয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার মামলায়। কিন্তু মূল হোতা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাহিরে। এ নিয়ে সাধারণ কৃষকদের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। কিভাবে দশ বছর ধরে কোটি কোটি টাকার সার অবৈধভাবে উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লিটন দেবনাথের মুখোমুখি অপরাধ বিচিত্রা। প্রশ্ন শুনেই ঘাবড়ে যান কৃষি কর্মকর্তা।

জানান, তিনি যোগদানের আগে থেকেই এ অনিয়ম চলছে। ২০১৩ সালে তিনি যোগদানের পর থেকে দীর্ঘ সাত বছরেও অনিয়ম চোখে পড়েনি তার। অবশ্য সরকারি এ অনিয়মের খবর পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর মৃত এম এ সবুরের মূল স্বাক্ষরের সাথে ভুয়া স্বাক্ষর চোখে দেখেই দশ বছরের জাতিয়াতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন তিনি। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, অপরাধ কর্মকান্ডের সাথে কারা জড়িত। তিনি বলেন, সার ডিলারের ফটিকছড়ির প্রতিনিধি হারুনের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন-নবী এন্ড সন্সের মালিক ও তার ম্যানেজার আজগর এ জাতিয়াতির কাগজ প্রস্তুত করে দিত।

লিটন দেবনাথের ভাষ্যমতে, তিনি যে নবী এন্ড সন্সের কথা বলেছেন সেটাতো অভিযুক্ত আবু শাহাদাতের মৃত বাবার প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানের নামেও শাহাদাত জালিয়াতি করেছিল। কিন্তু হারুণের কাছ থেকে জানার পরও নবী এন্ড সন্সের শাহাদাত কিভাবে আসামী থেকে বাদ গেল আর মামলার তথ্যমতে, তার ম্যানেজার আজগর কিভাবে এম এ সবুর এন্ড সন্সের ম্যনেজার হল তার কোন উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মৃত এম এ সবুরের প্রতিষ্ঠানের নামে যেহেতু সার উত্তোলন হত তাই অনিয়ম ধরা পড়ার কারণে উত্তরাধিকার সূত্রে মামলার আসামী হয়েছেন তার ছেলে ইসহাক।

তবে এ অনিয়মের সাথে ইসহাকের জড়িত থাকার বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই লিটন দেবনাথের কাছে। তাহলে কিভাবে মামলায় আসামী করলেন লিটন দেবনাথ, জানতে চাইলে তার কাছে। তিনি বলেন, ঘটনার সাথে যাদেরকে জড়িত মনে হয়েছে, তাদেরকে তিনি আসামী করেছেন। তার মানে অনুমানের উপর ভিত্তি করে মামলা করেছেন লিটন দেবনাথ। মামলার বিষয়ে সেসময় ফটিকছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ বলেন, মামলাটি ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সাথে জড়িত সকলকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

four × 2 =